দায়মুক্তি ভেঙে জবাবদিহি ফেরান
বিদ্যুৎ খাত
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রণীত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১) মূলত দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি দ্রুত মোকাবিলার লক্ষ্যে করা হয়েছিল। কিন্তু চৌদ্দ বছরের অভিজ্ঞতা বলছে- এই আইন কার্যত বিদ্যুৎ খাতকে অস্বচ্ছ, দায়মুক্তি ও দুর্নীতির অন্যতম আশ্রয়স্থলে পরিণত করেছে। বর্তমান সরকার গঠিত উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেই প্রমাণ। প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, এ আইনের আওতায় ভারতের আদানি গ্রুপসহ দেশি-বিদেশি বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তিতে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে।
মূলত এই আইনের মাধ্যমে টেন্ডার প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। ফলে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র বা স্বচ্ছ ক্রয়প্রক্রিয়া নিশ্চিত হয়নি। চুক্তি হয়েছে গোপনে, অনেকে সুবিধা নিয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়ে। এতে জনগণের করের অর্থে তৈরি হয়েছে এমন এক বিদ্যুৎব্যবস্থা, যেখানে দাম বেড়েছে অথচ সেবা উন্নত হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুতের দাম প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি, আর ভর্তুকি বাদ দিলে তা দাঁড়ায় ৪০ শতাংশে। শিল্প খাতের ওপর এর প্রভাব ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান- উৎপাদন খরচ বেড়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা হারাচ্ছে দেশি শিল্প। বিদ্যুৎ খাতের এই অদক্ষতা ও দুর্নীতি শুধু অর্থনীতিকে নয়, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি আয়ের ভবিষ্যৎকেও বিপন্ন করছে।
আরও উদ্বেগজনক হলো, এই দুর্নীতির সঙ্গে পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্পগুলোর সম্পর্ক। বিশেষজ্ঞ কমিটি বলছে, দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ আইনের আওতায় অনেক প্রকল্পে পরিবেশগত বিধিনিষেধ উপেক্ষা করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে এমন এলাকায়, যেখানে পরিবেশগত ক্ষতি অনিবার্য ছিল। এই ধরনের অপরিকল্পিত প্রকল্প শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করেনি, বরং স্থানীয় জনগণের জীবন-জীবিকাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। তাছাড়া এই চুক্তিগুলো- আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে ইচ্ছামতো বাতিল করা সম্ভব নয়। এতে বোঝা যায়, দুর্নীতির এমন এক জটিল জাল বোনা হয়েছে, যেখান থেকে বের হতে গেলেও দেশের অর্থনীতি ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর ঝুঁকি তৈরি হবে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
২০১১ সালে যেখানে বিদ্যুৎ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছিল ৬৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার, সেখানে ২০২৪ সালে সেই ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে। উৎপাদন চারগুণ বেড়েছে, কিন্তু অর্থ পরিশোধ বেড়েছে ১১ গুণ- এই বৈষম্য কোনোভাবেই অর্থনৈতিক যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা যায় না। ফলে স্পষ্ট যে, বিদ্যুৎ খাতের অকার্যকারিতা কেবল ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা নয়, এটি একটি পরিকল্পিত আর্থিক লুটপাট।
এই অবস্থায় প্রশ্ন জাগে- জনগণের করের অর্থে গড়ে ওঠা এই খাতের জবাবদিহি কোথায়? দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অধীন থাকায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এক ধরনের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা তৈরি হয়েছিল। এর ফলে নীতিনির্ধারণ থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যন্ত অনেক কিছুই হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়, পেশাগত মূল্যায়নের বদলে। আর এই সুযোগেই দুর্নীতিবাজ মহল গড়ে তুলেছিল নিজেদের সাম্রাজ্য।
আমরা মনে করি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতকে স্বচ্ছতার আওতায় আনতে হবে। চুক্তিগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা, সংসদীয় কমিটির তত্ত্বাবধান জোরদার করা এবং দুর্নীতির তদন্তে স্বাধীন কমিশন গঠন সময়ের দাবি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান সংকট কেবল আর্থিক নয়- এটি নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পতনের প্রতিফলন। যার বোঝা বহন করছে জনগণ, যারা প্রতিদিন বাড়তি বিল দিচ্ছে কিন্তু স্থিতিশীল বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। কখনও লোডশেডিং, কখনও ভর্তুকির চাপ- সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাত আজ এক গভীর আস্থাহীনতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
এখন সময় এসেছে বিশেষ আইনের নামে প্রতিষ্ঠিত এই দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করার। বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও প্রতিযোগিতামূলক ক্রয়নীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই বিদ্যুৎ খাতের এই গভীর অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার একমাত্র পথ হলো- দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলা, দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভেঙে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পথে অগ্রসর হওয়া।