জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে
বিদেশি প্রশিক্ষণ ফলশূন্য
বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ সরকারি মানবসম্পদ উন্নয়নের অন্যতম কার্যকর উপায় হওয়ার কথা। এর উদ্দেশ্য হলো দেশের প্রশাসনিক ও কারিগরি সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উন্নত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই প্রশিক্ষণ এখন কার্যকর মানবসম্পদ উন্নয়নের চেয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থে আরামদায়ক বিদেশভ্রমণের সুযোগে পরিণত হয়েছে। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে সাম্প্রতিক অডিট রিপোর্ট এ কথারই প্রমাণ দিয়েছে।
অর্থবছর ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত সময়ে তিনটি অধিদপ্তরের অধীন ১৩টি প্রকল্পে ৩৩৯ জন কর্মকর্তাকে ১৩টি দেশে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়, যার ব্যয় ছিল প্রায় ৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। কিন্তু এই বিপুল ব্যয়ের সুফল মাঠপর্যায়ে কোথাও দেখা যায়নি। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, বিদেশে প্রশিক্ষণ শেষে সাত কার্যদিবসের মধ্যে অংশগ্রহণকারীদের অভিজ্ঞতা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশই তা জমা দেননি। কেউ কেউ প্রশিক্ষণ শেষে অবসরে চলে গেছেন, কেউ বা প্রকল্পসংশ্লিষ্ট না হয়েও বিদেশে গেছেন। নীতিমালা ভেঙে ৫৫ বছর বয়সোত্তীর্ণ কর্মকর্তাদেরও প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে, যাদের অনেকে দেশে ফিরে আর কোনো কাজেই সেই অভিজ্ঞতা প্রয়োগের সুযোগ পাননি।
সরকার যেভাবে বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে, তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নেই। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থে মানবসম্পদ উন্নয়নের যে লক্ষ্য ছিল, তা মুখ থুবড়ে পড়ছে। আরও উদ্বেগজনক হলো, প্রশিক্ষণের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা ছিল না। বুদ্ধিবৃত্তিক ও পেশাগত সেবা কেনায় নিয়ম না মানা, নির্ধারিত হারে ভ্যাট ও আয়কর কর্তন না করা, এমনকি নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ খাত বাদ দিয়ে অন্য খাত থেকে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। অর্থাৎ এটি শুধুই দুর্নীতির নয়, বরং নীতিনৈতিকতার চরম অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। যেখানে একটি উন্নয়নশীল দেশের প্রতিটি টাকার গুরুত্ব অপরিসীম, সেখানে এমন অদূরদর্শী ব্যয় রাষ্ট্রের জন্য এক ধরনের আত্মঘাতী পদক্ষেপ। বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদের এই অপচয় আসলে জনগণের পকেট কাটা।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
সরকারের অভ্যন্তরে এই অনিয়ম বহু বছর ধরেই চলে আসছে, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি যারা প্রশিক্ষণ শেষে অভিজ্ঞতা প্রতিবেদন দেননি, তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে এক ধরনের দায়হীনতা পুরো ব্যবস্থার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।
মনে রাখতে হবে, সত্যিকারের উন্নয়ন কেবল প্রকল্পের সংখ্যা বা ব্যয়ের অঙ্কে নয়, বরং তার কার্যকারিতায় মাপা হয়। মাঠপর্যায়ে ফল না এলে বিদেশে প্রশিক্ষণের স্তূপ কোনো অর্থ বহন করে না। রাষ্ট্রের অর্থে শেখার সুযোগ পাওয়া মানে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ হওয়া।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এই অবস্থার অবসান ঘটাতে হলে প্রথমেই দরকার কঠোর প্রশাসনিক নজরদারি। বিদেশে প্রশিক্ষণ নীতিমালায় বয়সসীমা ও যোগ্যতার মানদণ্ড কঠোরভাবে প্রযোজ্য করতে হবে। প্রশিক্ষণ শেষে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অভিজ্ঞতা প্রতিবেদন জমা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং তা যাচাই করে মাঠপর্যায়ে প্রয়োগযোগ্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। যারা এই শর্ত মানবেন না, তাদের পদোন্নতি বা আর্থিক সুবিধা স্থগিত করা উচিত।
এ ছাড়া প্রকল্পসংশ্লিষ্ট নয় এমন কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানোকে সরাসরি দুর্নীতির পর্যায়ে গণ্য করে এর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। অডিট রিপোর্টে যে অনিয়মগুলো চিহ্নিত হয়েছে, তার তদন্ত ও দায় নির্ধারণ ছাড়া ভবিষ্যতে এমন অপচয় বন্ধ হবে না। রাষ্ট্রীয় অর্থ জনগণের আমানত। সুতরাং জনসাধারণের অর্থ ব্যয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২