ভবিষ্যতের জন্য করণীয়
একসময় বাংলাদেশের নদীগুলো ছিল জীবনের উৎস। কৃষকরা নদীর পানি ব্যবহার করে জমিতে সেচ দিতেন, খাল-বিল ছিল মাছ ও কৃষির আশ্রয়স্থল। চারদিকে ছিল অফুরন্ত পানির সরবরাহ, আর পানির সংকট তখন কারও কল্পনায়ও আসেনি। কিন্তু আজ সেই চিত্র সম্পূর্ণ বদলে গেছে। বিশুদ্ধ পানির অভাব এখন বৈশ্বিক সংকট, যা ভবিষ্যতে মানবসভ্যতার অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে।
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী দশকে পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হবে মিঠাপানির সংকট। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানির অভাবে ভুগবে। বর্তমানে বিশ্বের ২.২ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানির সেবা থেকে বঞ্চিত এবং ২০২২ সালে ৭৮৩ মিলিয়ন মানুষ ভুগেছে অপুষ্টিতে। অন্যদিকে ধারণা করা যাচ্ছে, ২০৫০ সালে বিশ্ব জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৯৮০ কোটিতে, যা পানি ও খাদ্য উভয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে ভয়াবহ মাত্রায়।
পানি আজ কেবল প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, বরং একটি ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধেও দেখা যাচ্ছে, বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের অভাবে ফিলিস্তিনিরা মানবিক বিপর্যয় পড়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে যেভাবে দেশগুলোর মধ্যে পানিসংকট ও খাদ্য নিয়ে টানাপড়েন বাড়ছে, তা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য যুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়। যেমন- মিশর ও ইথিওপিয়ার মধ্যে নীলনদকে কেন্দ্র করে বিরোধ, ভারত ও পাকিস্তানের সিন্ধু চুক্তি নিয়ে উত্তেজনা, কিংবা গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের আলোচনা। অতীতে যুদ্ধ হয়েছে তেল ও ভূমির জন্য, ভবিষ্যতের যুদ্ধ হবে পানির জন্য। বিশেষজ্ঞদের এমন সতর্কবার্তা এখন আর কল্পনা নয়, বাস্তব সম্ভাবনা।
জলবায়ু পরিবর্তন পানির প্রাপ্যতা ও খাদ্য উৎপাদন দুটিকেই বিপর্যস্ত করে তুলছে। হিমবাহ গলে যাচ্ছে, নদীর প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার মাটিকে বিষাক্ত করছে, ফলে ফসলের উৎপাদন কমছে এবং খাদ্য ঘাটতি বাড়ছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, জলাশয় দখল ও পাম্পিংয়ের ফলে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। এর ফলে কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্য- সবকিছুই হুমকির মুখে পড়ছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
পানির অভাবের সরাসরি প্রভাব পড়ছে খাদ্যনিরাপত্তায়। কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেলে খাদ্যের দাম বেড়ে যায়, অপুষ্টি বৃদ্ধি পায়,এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এভাবেই পানিসংকট ও খাদ্যসংকট একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে অন্ধকারের মাঝেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে। মানবজাতি ইতোমধ্যে এমন অনেক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে যা পানি ও খাদ্য সংকট মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। হাইড্রোপনিক ও ভার্টিক্যাল ফার্মিং এখন শহুরে কৃষিতে বিপ্লব এনেছে। এতে প্রচলিত কৃষির তুলনায় ৯০ শতাংশ পানি সাশ্রয় হয় এবং ১০০ গুণ বেশি ফলন সম্ভব। ড্রিপ সেচ প্রযুক্তি ফসলের শিকড়ে সরাসরি পানি পৌঁছে দিয়ে অপচয় কমায় এবং উৎপাদন বাড়ায়। বায়োটেকনোলজি এমন ফসল উদ্ভাবন করেছে যা খরা, লবণাক্ততা বা অতিরিক্ত তাপমাত্রার মধ্যেও টিকে থাকতে পারে। খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘ড্রট-রেজিস্ট্যান্ট’ ধান ও গমের জাত, যা স্বল্প পানিতে উৎপাদন সম্ভব করছে।
পানিশোধনের ক্ষেত্রেও এসেছে বিপ্লব। রিভার্স অসমোসিস, খরভবঝঃৎধি এবং ইলেকট্র্রোডায়ালাইসিস প্রযুক্তি দূষিত পানিকে বিশুদ্ধ করছে। যদিও এগুলো এখনও ব্যয়বহুল, তবে ব্যাপক উৎপাদন ও সহযোগিতার মাধ্যমে সহজলভ্য করা সম্ভব। ইসরায়েল তার ৮৫% বৃষ্টির পানি পুনর্ব্যবহার করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমরা যতই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করি, যদি ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে অপচয় কমানো না যায়, তবে কোনো প্রযুক্তিই টেকসই হবে না। এ জন্য সর্বপ্রথম আমাদের মনোভাব ও আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। প্রতিটি ফোঁটা পানি অপচয় মানে একটি প্রাণের জন্য হুমকি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বিশ্বের সীমান্ত নদীগুলোর পানিবণ্টন এখন এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা। জাতিসংঘের উচিত আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করে নিশ্চিত করা, যেন কোনো দেশ একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে অন্য দেশের পানিপ্রবাহ বন্ধ করতে না পারে।
একই সঙ্গে দরকার আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রযুক্তি স্থানান্তর। বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন প্রযুক্তি ও আধুনিক কৃষি উদ্ভাবন যেন কেবল ধনী দেশ বা কোম্পানির একচেটিয়া সম্পদ না হয়, বরং তা বৈশ্বিক মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হয়।
বিশ্ব দ্রুত এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে যেখানে পানি ও খাদ্য হবে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নির্ভর করবে আমরা আজ কীভাবে এই সম্পদ ব্যবহার ও সংরক্ষণ করি তার ওপর। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও নৈতিকতা- এই তিনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আসন্ন সংকট মোকাবিলা করতে পারে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
আমাদের যুদ্ধ হোক অস্ত্রের নয়, সচেতনতার, সংযমের ও মানবিকতার। কারণ যখন আমরা অবহেলায় পানি নষ্ট করি, তখন পৃথিবীর কোথাও কেউ তৃষ্ণায় কাতরায়।
সাদিক আহমেদ প্রান্ত : লেখক