সহজে মেলে, কঠিন করে চাওয়া কেন
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। একটি হচ্ছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ, গণভোট, তারপর ২৭০ দিনের মধ্যে না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধান সংশোধন হয়ে যাবে। তো এমন কোনো নজির আছে কিনা, আদৌ সম্ভব কিনা, এটা তারা দেখবে। দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো, এই দায়দায়িত্ব নির্বাচিত সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। কথাগুলো আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের।
কিন্তু কথা হচ্ছে, এগুলো হবে গণভোটে হ্যাঁ জয়যুক্ত হলেই কেবল। ‘গণভোটে উপস্থাপিত প্রশ্নের উত্তরে প্রদত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট ইতিবাচক (হ?্যাঁ-সূচক) হইলে।’ এরপর হবে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ, যেটি সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গাঠনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। এরপর ২৭০ দিনের মামলা।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারির এখতিয়ার সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত।
৩০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত দলটির স্থায়ী কমিটির এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল এ কথাগুলো বলেন।
কেউ কেউ বলছেন- জনগণের মতামতের জন?্য গণভোটে যেতে চাইছেন, আবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদের হাত-পা বেঁধেও দিতে চাইছেন। বিষয়টি স্ববিরোধ হয়ে যায় না? উত্তর হলো- যায় না; যদি জনগণ গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত করে।
ফ্রান্সপ্রবাসী জামায়াতি ঘরানার ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য লিখেছেন- জুলাই সনদকে ‘হ্যাঁ’ বলা নিয়ে আমার সর্বশেষ পোস্টে এক লাখ ৮৭ হাজার রিঅ্যাক্ট পড়েছে। বিএনপির বেকুব গ্রুপ ও বাকশালিরা মিলে ৫৫ হাজার ‘হা হা’ দিয়েছে। আর বাংলাদেশপন্থিরা এক লাখ ৩০ হাজার লাভ+লাইক রিঅ্যাক্ট করেছে।
অন্যদিকে সাহেদ আলম নামের আরেক সাংবাদিক লিখেছেন- আপনারা যারা নির্বাচনের আগে গণভোট নিয়ে এত আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছেন, আপনারা কি বিচক্ষণতার রাজনীতি করছেন? বিএনপিকে জোরজবরদস্তি করেই যেহেতু গণভোট চাপিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে, সেহেতু ধরে নিলাম তারা ‘না’ ভোট দেবে। অন?্যদিকে, আওয়ামী লীগবিহীন সংস্কার প্রস্তাব বা প্রক্রিয়ার কারণে তারা তাদের কর্মী-সমর্থকদের বলতে পারে ‘না’ ভোট দিতে। পরে হায় হায় করার আগে প্রয়োজনে চুপ থাকেন। ভেজাল বাধায়েন না।
দুই.
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়ে এক যুগ ধরে বাংলাদেশে দাবিটিকে জনপ্রিয় করেছে। ৩০ অক্টোবর ২০২৫ প্রেস কনফারেন্সে তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন অধ্যাদেশ ২০২৫-এর সুপারিশ চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে পুনরায় ঐকমত্য সভার আয়োজন করার দাবি তুলেছে।
জুলাই অভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা সংস্কার আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ পাঁচ মাস যাবৎ ঐকমত্য সভায় আলাপ-আলোচনার পর ঐকমত্য কমিশন তার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ জাতির সামনে উপস্থাপন করেছে। ঐকমত্য কমিশন যে ঐক্যকে সামনে রেখে প্রায় এক বছর যাবৎ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, বাস্তবায়নের সুপারিশ সেই ঐক্যকে একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে নিয়ে ফেলেছে।
চ্যালেঞ্জের মূল কারণ হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যেটুকু আলোচনা হয়েছিল সেখানে এই প্রস্তাবে উল্লেখিত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া উপস্থাপন করা হয়নি। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছনোর পর যদি এই প্রস্তাব জাতির সামনে হাজির করা হতো সে ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ আমরা পরিহার করতে পারতাম।
ঐকমত্য কমিশনে বাস্তবায়ন নিয়ে আলাপে রাজনৈতিক দলগুলো গণভোটের মাধ্যমে পরবর্তী সংসদকে সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছিল, কিন্তু যেসব প্রস্তাবে কিছু দল আপত্তি জানিয়েছিল সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
সংস্কার প্রস্তাবের নোট অব ডিসেন্টগুলোকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ থেকে মুছে দেওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মনে করে, দ্রুত আমরা এই সুপারিশ থেকে বের হয়ে না এলে রাজনৈতিক দলগুলোর এক অংশের ভেতরের যৌক্তিক ক্ষোভ পরবর্তী সময়ে দেশের মানুষের ভেতর সঞ্চালিত হয়ে পড়বে।
সারাদেশের মানুষ যখন নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে তখন রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশের প্রতি কৃত অন্যায় অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। আর নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠলে দেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে এবং দেশের মানুষকে স্বৈরাচার সরকারের সময়ের চেয়ে উন্নত কোনো জীবন উপহার দেওয়ার সুযোগ হারিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ যাতে এই সংকটে গিয়ে না পড়ে সে জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, ঐক্য কমিশনকে দ্রুত তাদের এই সুপারিশ নিয়ে পুনরায় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐকমত্য সভার আয়োজন করার দাবি জানাচ্ছে।
তিন.
গণভোট হলো ম্যান্ডেট। সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের ম্যান্ডেট। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে সংস্কার পরিষদে ও জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে কারা নির্বাচিত হবেন তার ম্যান্ডেট।
সংস্কার পরিষদের কাজ কী? সংবিধানের যে নোট অব ডিসেন্টগুলো আছে সেগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা। বিএনপি বা গণতন্ত্র মঞ্চ বা এনসিপি বা জামায়াত- যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে, তারা নোট অব ডিসেন্ট বিষয়ে যে মত দেবে সেটাই হবে। দূর ভবিষ্যতে কেউ যদি নোট অব ডিসেন্টগুলো সংস্কার করতে চায়, তারা গণভোট দিয়ে করে নেবে, এটাই ঐকমত্য কমিশনে সিদ্ধান্ত ছিল। আর যেগুলোতে নোট অব ডিসেন্ট নেই, সেগুলো গণভোটের পরে সংস্কার পরিষদে পাস হয়ে যাবে। বিএনপি চাইলেও সেগুলো বদলাতে পারবে না। কারণ জুলাই সনদে বিএনপি স্বাক্ষর করেছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আলাদা করে গণভোট হলো। জামায়াতের তাহের সাহেবের কথামতো সংস্কার পরিষদ গঠনের জন্য জাতীয় নির্বাচন আর হলো না। তাহলে মাঝখানে দেশ কী দিয়ে চলবে? যে দলটি কদিন আগে নিম্নকক্ষে পিআর নিয়ে আওয়াজ দিয়ে নিভে গেল, সেই দল একের পর এক বায়না তুলবে, তার কথায়?
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?
আর যদি ‘না’ ভোট জেতে? আবার আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গেলাম। এত রক্ত, এত ত্যাগ, গত দশ মাস ধরে ঐকমত্য কমিশনের এত আলাপ বৃথা তো যাবেই, খোদ সরকারই সংকটের মধ্যে পড়বে। আগের নির্বাচনগুলোর হিসাব মতে, বিএনপির সবগুলো পার্টির মোট ভোটারের চেয়েও আট দশগুণ বেশি। তাদের সমর্থন ছাড়া গণভোটে এই ফলই আসার কথা। গণ-অভ্যুত্থানের পার্টি হিসেবে এনসিপি কীভাবে খেলায় পা দেয়?
সর্বশেষ গণভোটে ভোট পড়েছিল ৩৪ শতাংশ। কারণ প্রার্থী না থাকায় ভোটারদের তাগিদ দেওয়ারও কেউ থাকে না। আর যে গণভোট নিয়ে কারও আপত্তি ছিল না, যে গণভোট ১০০% সমর্থনে পাস হওয়ার কথা, সেখানে বিভক্তি আনলেন। গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গেই না করে কোন সর্বনাশা খেলায় নামছি? যা অনায়াসে পেতে পারতাম, তা হেলায় হারাব?
নাহিদ হাসান : কবি, লেখক ও সংগঠক
মতামত লেখকের নিজস্ব