বিচারবহির্ভূত হত্যা এখনই বন্ধ করতে হবে
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। স্বৈরাচারী ও দলীয় আধিপত্যের রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে জনগণ চেয়েছিল এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে। সে প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। সরকারের প্রতি তখন জনমনে ছিল বিপুল আস্থা- বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে, এমনটাই ছিল প্রত্যাশা। কিন্তু ১৪ মাস পার হতে না হতেই বাস্তব চিত্র হলো হতাশার।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালেই ৪০টি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সংখ্যাটি হয়তো আগের শাসনামলের তুলনায় কম, কিন্তু গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি উচ্চ অঙ্গীকার নিয়ে দায়িত্ব নেওয়া সরকারের জন্য এটি অগ্রহণযোগ্য। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, এসব ঘটনার মধ্যে যৌথ বাহিনীর সম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি। (৭টি ঘটনায়।) পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ৩টি এবং একটির জন্য দায়ী করা হয়েছে সেনাসদস্যকে। অর্থাৎ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর আচরণে যে মানসিক পরিবর্তন প্রত্যাশিত ছিল, তা বাস্তবে দেখা যায়নি।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি ভয়াবহ প্রবণতা- অজ্ঞাত লাশ ও কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) জানিয়েছে, শুধু গত অক্টোবর মাসেই উদ্ধার হয়েছে ৬৬টি অজ্ঞাত লাশ, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ৫২টি। কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও বেড়ে ১৩ জনে দাঁড়িয়েছে, যেখানে আগের মাসে ছিল ৮। এই পরিসংখ্যান কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনের নয়, রাষ্ট্রীয় দায় এড়ানোর এক ভয়াবহ চিত্রও তুলে ধরে। পুলিশ এসব লাশ উদ্ধার করেই দায়িত্ব শেষ করছে, তদন্ত বা বিচারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
স্বাভাবিকভাবেই জনমনে প্রশ্ন উঠছে- সরকার কি নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারছে? বিচারবহির্ভূত হত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার এক গভীর রোগের লক্ষণ। কোনো সরকারই যদি আইন ও বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর আস্থা না রেখে বন্দুকের নল দিয়ে শৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা করে, তবে তা গণতান্ত্রিক নয়; বরং ভয়ভীতিনির্ভর শাসনব্যবস্থার দিকে নিয়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য ছিল সেই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। অথচ দেখা যাচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর পর্যাপ্ত নজরদারি বা জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকায় একই ধারা চলমান রয়েছে।
এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে আসে- অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার আসলে কী? যদি মানবাধিকার রক্ষা, বিচারপ্রক্রিয়ার সংস্কার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠাই হয় প্রধান লক্ষ্য, তবে কেন এসব ঘটনার পরও দায়ীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে না? প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে, দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব, যদি সরকার সদিচ্ছা দেখায়। এখনই সেই সময় অন্যথায় ‘অন্তর্বর্তী’ শব্দটি ইতিহাসে নতুন আশার প্রতীক হয়ে নয়, ব্যর্থ প্রতিশ্রুতির প্রতীক হয়ে থাকবে।