বৈষম্য দূর করুন
বাংলাদেশ একটি দেশ, যেখানে নারী নেতৃত্বের উত্থান ইতিহাসের পাতায় গৌরবের বিষয়। দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ পদে নারী নেতৃত্বের উপস্থিতি বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী নেত্রীর নেতৃত্ব এক প্রতীক, কিন্তু নারী রাজনীতিকের বাস্তব অবস্থান এখনও প্রান্তিক ও সংগ্রামী। রাজনীতির এই বৈষম্য কেবল এক দলের নয়, প্রায় সব দলের। দলগুলোতে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত, এবং যেসব নারী নেতৃত্বে আছেন, তাদের অধিকাংশই প্রতীকী বা পারিবারিক সূত্রে উঠে আসা। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের বিকাশ প্রকৃত অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি। এই বৈষম্যের শিকড় সমাজে যেমন গভীর, তেমনি দলীয় সংস্কৃতিতেও তা প্রোথিত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মূল সমস্যা হলো- তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চর্চা করে না। দলীয় কমিটি থেকে শুরু করে মনোনয়ন প্রক্রিয়া পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রিত এবং আনুগত্যনির্ভর। এতে নারী রাজনীতিকরা অনেক সময় সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পিছিয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি- দুটো দলেই নারী নেতৃত্ব আছে, কিন্তু দলীয় গঠনে নারী নেত্রীদের সংখ্যা অল্প এবং তৃণমূল পর্যায়ে তা প্রায় অদৃশ্য। সিদ্ধান্ত গ্রহণে, নীতি প্রণয়নে বা প্রার্থী মনোনয়নে নারীদের ভূমিকা সীমিত। নারীরা অনেক সময় সাংগঠনিক দায়িত্ব পান, কিন্তু সেই দায়িত্বের সঙ্গে প্রকৃত ক্ষমতা থাকে না। তারা কাজ করেন, প্রচারণা চালান, কিন্তু পুরুষ নেতারা সিদ্ধান্ত দেন।
নারী রাজনীতিকরা প্রায়ই বলেন- দল তাদের মূল্যায়ন করে না, মনোনয়নের ক্ষেত্রে সুযোগ দেয় না কিংবা তাদের কাজকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ভূমিকা হয় কেবল মিছিল-মিটিংয়ে উপস্থিত থাকা বা দলের মুখ হিসেবে কাজ করা। প্রকৃত সংগঠন পরিচালনা বা কৌশলগত পরিকল্পনায় তাদের স্থান নেই। জামায়াতে ইসলামী বা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ক্ষেত্রে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ আরও সীমিত।
রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে পুরুষদেরই আধিপত্য। নারী নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা নেই, প্রশিক্ষণ বা সংগঠিত হওয়ার সুযোগও নেই। বাংলাদেশে সংসদে নারীদের উপস্থিতি একটি ইতিবাচক দিক বটে, কিন্তু সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা এই সাফল্যকে সীমিত করেছে। সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে সংসদে অনেক নারী প্রবেশ করেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই দলের মনোনয়নে আসেন- জনগণের ভোটে নয়। ফলে তাদের ওপর দলের নিয়ন্ত্রণ থাকে, তারা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান নিতে পারেন না। সংরক্ষিত আসনের এই কাঠামো নারী নেতৃত্ব বিকাশের পরিবর্তে পুরুষ নেতৃত্বের প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করে। রাজনৈতিক বৈষম্যের আরেকটি দিক হলো- নারী রাজনীতিকদের সামাজিক চিত্রায়ণ। তাদের কাজের পরিবর্তে প্রায়ই তাদের পোশাক, চলাফেরা বা ব্যক্তিগত জীবনকে কেন্দ্র করে আলোচনা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী নেত্রীদের নিয়ে ট্রল, কটূক্তি, অবমাননাকর মন্তব্য নিয়মিত ঘটে। পুরুষ রাজনীতিকরা একই কাজ করলে প্রশংসা পান, কিন্তু নারী রাজনীতিকরা সমালোচিত হন। এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক সহিংসতা, যা নারীর রাজনীতিতে আগ্রহ কমিয়ে দেয়। তাছাড়া রাজনীতিতে নারীরা প্রায়ই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে- নারী নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় বাধা সাংগঠনিক সংস্কৃতি। দলগুলো এখনো ব্যক্তিনির্ভর, গণতন্ত্রচর্চা সীমিত, মতবিনিময় বা বিতর্কের জায়গা নেই। সিদ্ধান্ত আসে ওপর থেকে, নিচে কেবল বাস্তবায়ন হয়। এই কেন্দ্রীভূত কাঠামোতে নারী নেতৃত্বের বিকাশ অসম্ভব। নারীরা যারা সক্রিয়, তারা প্রায়ই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন কোনো পুরুষ নেতার ওপর- যিনি তাদের সুযোগ করে দেন বা প্রতিশ্রুতি দেন। ফলে নেতৃত্ব স্বাধীন নয়; বরং পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত। তবু আশার আলো নিভে যায়নি। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও পৌরসভায় অনেক নারী এখন জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। তারা মাঠপর্যায়ে জনগণের সঙ্গে সরাসরি কাজ করছেন, উন্নয়ন কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছেন, নিজেদের অবস্থান তৈরি করছেন। এই অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের ভিত্তি হতে পারে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধিকে স্থায়ী করতে হলে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন। দলগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে কমিটির অন্তত এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। সংরক্ষিত আসনের বাইরে নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহ দিতে হবে এবং দলীয় রাজনীতিতে নারীদের প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্ব উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করা খুবই দরকার। এ ছাড়া গণমাধ্যম ও সমাজকেও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নারী রাজনীতিকদের ‘নারী’ নয়, ‘নেতা’ হিসেবে দেখা জরুরি। তাদের রাজনৈতিক ভাবনা, কাজ ও অবদানকে মূল্যায়ন করতে হবে। রাজনীতিতে নারীর অগ্রগতি সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত; এটি কেবল নারী ইস্যু নয়, গণতন্ত্রের ইস্যু। বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক সন্ধিক্ষণে। নারীকে কেবল স্লোগান বা প্রতীকে সীমাবদ্ধ না রেখে তাদের জন্য সমান সুযোগ, মর্যাদা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর নেতৃত্ব কোনো দয়া নয়, এটি প্রাপ্যতা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীরা শুধু সহযাত্রী নন, তারা ভবিষ্যতের স্থপতি। তাই এখন সময় এসেছে রাজনীতির কাঠামো থেকে বৈষম্যের অদৃশ্য প্রাচীর ভাঙার। ক্ষমতার টেবিলে নারী ও পুরুষকে একসঙ্গে বসতে হবে- সমান মর্যাদায়, সমান অধিকার নিয়ে। যেদিন বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলে নারী নেত্রীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে, নীতি প্রণয়নে, নির্বাচনী নেতৃত্বে পুরুষের সমান ভূমিকা পাবেন, সেদিনই দেশের রাজনীতি হবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও মানবিক।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এসএম রায়হান মিয়া : শিক্ষক ও কলাম লেখক