প্রতিদিনের জীবনে বিষ
একুশ শতকের মানুষের প্রতিদিনের আরামদায়ক জীবনের পেছনে লুকিয়ে আছে এক নীরব হত্যাকারী-প্লাস্টিক। একসময় এটি ছিল মানবসভ্যতার ‘উন্নয়নের প্রতীক’। কিন্তু আজ এটি পৃথিবীর প্রতিটি নদী, সমুদ্র, বন, এমনকি মানুষের শরীরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার গত দুই দশকে ৭ গুণ বেড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৫ সালে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ছিল ৩ কেজি, এখন তা বেড়ে ২৪ কেজিরও বেশি (২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী)। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক, যা মূলত খাদ্য মোড়ক, প্যাকেট ও বাজারের পলিথিন ব্যাগে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহর একাই প্রতিদিন ৬০০-৭০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করে, যার মাত্র ৩৬% পুনর্ব্যবহার হয়, বাকিটা যায় নদীতে, ড্রেনে ও মাটিতে। ফলে রাজধানীর চারপাশের নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু এখন প্লাস্টিকের ভাসমান জঞ্জালে ভরে গেছে।
প্লাস্টিকের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিক, যা মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা যায় না। যখন বড় প্লাস্টিক ভেঙে সূক্ষ্ম কণায় পরিণত হয়, তখন তা মাটি, পানি ও বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এখন পৃথিবীর কোনো জায়গাই মাইক্রোপ্লাস্টিকমুক্ত নয়, এমনকি হিমালয়ের তুষারেও এটি পাওয়া গেছে।
২০২২ সালে ‘এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণার ফলাফলে মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্তের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এই গবেষণায় সুস্থ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রায় ৮০%-এর রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া যায়।
প্লাস্টিক তৈরি হয় পেট্রোকেমিক্যাল থেকে, যার মধ্যে থাকে বিসফেনল এ (ইচঅ), ফথালেটস, স্টাইরিন, পলিভিনাইল ক্লোরাইড (চঠঈ) প্রভৃতি রাসায়নিক। এসব উপাদানকে বলা হয় এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টর, অর্থাৎ এগুলো শরীরের হরমোন সিস্টেমে হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে পুরুষদের টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায়, বন্ধ্যত্বের আশঙ্কা বাড়ে। নারীদের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (চঈঙঝ) ও ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। শিশুদের মানসিক বিকাশ ও ইমিউন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্লাস্টিক পোড়ানোর সময় যে ডাই-অক্সিন ও ফিউরান গ্যাস নির্গত হয়, তা ফুসফুস ও হৃদরোগ সৃষ্টি করে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
প্লাস্টিক দূষণের কারণে বৈশ্বিক পর্যায়ে বছরে ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং পরিবেশগত ক্ষতি হয়। এ ছাড়াও প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ থেকে ২ কোটি ৩ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জলজ বাস্তুতন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ে, যা জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে এবং খাদ্যশৃঙ্খলে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করায়। এই দূষণের ফলে প্রতিবছর অন্তত ১.৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্ষতির হিসাব করা না হলেওÑ নদীর প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় জলাবদ্ধতা, কৃষিজমিতে মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত ব্যয়Ñ এসব মিলিয়ে বছরে কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
প্লাস্টিক দূষণ শুধু পরিবেশ নয়, দারিদ্র্য ও জনস্বাস্থ্যের চক্রকেও জটিল করছে। কারণ নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠী এসব বর্জ্যরে ভেতরেই জীবন ধারণ করে, যেখান থেকে তারা সংগ্রহ করে অল্প দামে বিক্রির উপযোগী প্লাস্টিক। ফলে তারা নিজেই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে।
বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু দুই দশক পেরিয়ে গেলেও এই আইন আজও কার্যকর হয়নি। বাজারে এখনও পাতলা পলিথিন ব্যাগের স্রোত অব্যাহত। একদিকে আইন আছে, অন্যদিকে প্রয়োগ নেইÑ এই দ্বন্দ্বই এখন সবচেয়ে বড় বাধা। এ ছাড়া বিকল্প পণ্য, যেমনÑ জুটভিত্তিক বা বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেজিং শিল্পে সরকারি প্রণোদনা নেই বললেই চলে।
কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে প্লাস্টিকের দূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব; যেমনÑ বর্জ্য বাছাই ও পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। প্রতিটি শহরে আলাদা প্লাস্টিক রিসাইক্লিং প্লান্ট স্থাপন জরুরি। ‘জবফঁপব, জবঁংব, জবপুপষব’ নীতি শিক্ষা ও সংস্কৃতির অংশ করতে হবে। স্কুল থেকেই প্লাস্টিক-সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। জুট ও কাগজভিত্তিক বিকল্প পণ্য উৎপাদনে করছাড় ও প্রণোদনা দিতে হবে। প্লাস্টিক কর আরোপ ও নিষিদ্ধ পণ্যের বিকল্প বাজারনীতি তৈরি করা প্রয়োজন। গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ : যেমনÑ বায়োডিগ্রেডেবল পলিমার ও কম্পোস্টেবল প্যাকেজিং প্রযুক্তি। গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া ও কমিউনিটি পর্যায়ে ‘প্লাস্টিকমুক্ত জীবন’ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
প্লাস্টিক এখন কেবল একটি পণ্যের নাম নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক বৈশ্বিক বিপর্যয়। প্রতিদিন আমরা যে প্লাস্টিক ব্যবহার করছি, তা একদিন হয়তো আমাদের সন্তানদের খাবারে, পানিতে বা বাতাসে ফিরে আসবে।
এটি কেবল পরিবেশগত সংকট নয়, এটি মানব অস্তিত্বের সংকট। এখনই সময় রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিগত স্তরে সচেতন হওয়ার। আমরা যদি এখনও না জাগি, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা একটি ‘প্লাস্টিকের পৃথিবী’ উপহার দেব; যেখানে জীবনের চেয়ে সহজলভ্য হবে মৃত্যু।
আরিফুল ইসলাম রাফি : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!