অনিরাপদ কন্যাশিশু : রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও দায়

ফেরদৌস আরা রুমী
০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩১
শেয়ার :
অনিরাপদ কন্যাশিশু : রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও দায়

আমাদের কন্যাশিশু মানে এখনও অনিশ্চিত শৈশব, ভবিষ্যৎ আর অনিরাপদ এক যাত্রার নাম। প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতন, হয়রানি, সহিংসতা, খুন, ধর্ষণ, পারিবারিক নির্যাতন ইত্যাদি কন্যাশিশুর ভয়াবহ বাস্তবতাকে তুলে আনে সামনে। কিন্তু এই ভয়ংকর বাস্তবতা ঘিরে থাকার পেছনের কারণ কী? মনোসামাজিক বাস্তবতা নিয়ে আমরা কতটুকু সচেতন? কেন কন্যাশিশুরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়Ñ এর উত্তর সমাজে বিরাজমান পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা। এখানে একজন নারীকে ‘দ্বিতীয়’ নাগরিক হিসেবে দেখা এবং কন্যাশিশুকে অগুরুত্বপূর্ণ করে রাখা হয়। কন্যাশিশুর জন্ম এখনও অনেক পরিবারকে সুখী করে না। তাকে চিহ্নিত হতে হয় পরিবারের বোঝা হিসেবে। দরিদ্র পরিবারগুলোতে তাচ্ছিল্যের হার আরও বেশি। অন্যদিকে কন্যাশিশুর জন্য রাষ্ট্রের বিশেষ বাজেটও থাকে না, যা একজন কন্যাশিশুকে সমাজে ‘স্পেশাল’ ভাবতে উৎসাহী করবে। উপরন্তু তার জন্ম নেওয়াটি পরিবার-সমাজে সবার জন্য ‘অসুবিধা’ তৈরি করেছেÑ সবাই মিলে এই ধারণাটি দিতে থাকে। এই ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গিই পরিণত হয় অবহেলা, সহিংসতা এবং যৌন নির্যাতনের সাংস্কৃতিক বৈধতায়।

গত ১১ অক্টোবর পালিত হয়ে গেল আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিলÑ ‘আমি সেই মেয়ে, আমিই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিই : সংকটে সামনের সারিতে মেয়েরা’। সত্যিই সংকটে-সংশয়ে নারীরা এখন আর পিছিয়ে থাকে না। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে নারীরা ছিল অগ্রভাগে। বলা ভালো, বিপুলসংখ্যক নারী রাস্তায় নেমে এসেছে বলেই এই অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। কিন্তু এত সাফল্য বা অবদানের পরও নারীর প্রতি, বিশেষ করে কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা কোনোভাবে কম নয়। এমনকি অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে তার চিত্র বিগত বছরগুলোর মতো একই আছে কিংবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে আমরা তার আভাস পাই।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ২,১৫৯টি মামলা হয়েছে। একই সময়ে নারী ও শিশু ধর্ষণের অভিযোগে হয়েছে ২,৭৪৪টি মামলা। তবে এর মধ্যে কতটি কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তা আলাদাভাবে প্রকাশ করা হয়নিÑ যা রাষ্ট্রের সংবেদনশীলতার ঘাটতি তুলে ধরে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুসারে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৯ মাসে ৯৯৩ জন কন্যাশিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ১৫টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই নির্যাতনের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এই সময়ে ৩৫০ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৩ জনকে। এ ছাড়া ৮১ জন কন্যাশিশু খুনের শিকার হয়েছে। এই সময় ধর্ষণচেষ্টা, পাচার, যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্ত, বাল্যবিবাহসহ নানা ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সংকলিত তথ্য আরও উদ্বেগজনক। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে ৩৯০ জন কন্যাশিশু ধর্ষণ বা দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের ২২৪টির তুলনায় অনেক বেশি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে পারিবারিক বৃত্তে নির্যাতনের পর মোট ৪৭টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬টি শিশুর বয়স ছয় বছরের নিচে। যদিও এই পরিসংখ্যানে কন্যাশিশুর সংখ্যা আলাদাভাবে জানানো হয়নি, তথাপি এটি স্পষ্ট করে যে, পরিবারও শিশুদের নিরাপদ আবাস নয়।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুসারে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। চলতি বছর মার্চ মাগুরায় আলোচিত শিশু (আছিয়া) ধর্ষণের (পরে মৃত্যু) ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত করার জন্য আইনে সংশোধনী আনে অন্তর্বর্তী সরকার। পরে ২৫ মার্চ ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে। সংশোধনীতে শিশু ধর্ষণ অপরাধের বিচারে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন, ছেলে শিশুদের প্রতি যৌনকর্মকে ‘বলাৎকার’ নামে অন্তর্ভুক্ত করা, ধর্ষণের মামলায় তদন্ত ও বিচারের সময় কমানো, ‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম’ শিরোনামে নতুন ধারা সংযোজন করা, ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তথাপি আলোচিত সেই আছিয়ার ধর্ষণের পর মৃত্যুর ঘটনার রায় এখনও কার্যকর হয়নি; অন্যদিকে রায় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন আছিয়ার মা।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে শিশু ধর্ষণের ২২ হাজারেরও বেশি মামলার মাত্র ৩ শতাংশের দণ্ড হয়েছে। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি অপরাধীদের আরও বেপরোয়া করে তোলে। আইন থাকলেও প্রয়োগ মাঠে নেই। আইনের ঘাটতি শুধু প্রয়োগে নয়, কাঠামোগত দিকেও আছে। শিশু নির্যাতন মামলায় আলাদা ট্রাইব্যুনাল থাকলেও তার সংখ্যা সীমিত, তদন্তে শিশুবান্ধব পদ্ধতি নেই, ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর নিরাপত্তাব্যবস্থা অনুপস্থিত।

কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা শুধু আইন দিয়ে সম্ভব নয়; এটি সামগ্রিক মনোসামাজিক পরিবর্তনের দাবি রাখে। প্রথমত, শিক্ষাব্যবস্থায় লিঙ্গসমতা ও যৌন শিক্ষাবিষয়ক চ্যাপ্টার পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পরিবার পর্যায়ে কন্যাশিশুর প্রতি সম্মান, আত্মমর্যাদা ও আত্মরক্ষার শিক্ষা দিতে হবে। তৃতীয়ত, প্রশাসনিকভাবে শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিটি থানায় শিশু সেল কার্যকর করা, নির্যাতনবিরোধী হেল্পলাইনগুলোয় দ্রুত সাড়াদান, কার্যকারিতা বাড়ানো এবং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালগুলোর দক্ষতা বাড়ানো জরুরি।

শিশু সুরক্ষায় রাষ্ট্রে আইন ও নীতিমালা থাকলেও কার্যকর নয়। যেমন ধরা যাকÑ জাতীয় শিশুনীতি ২০১১, শিশু আইন ২০১৩, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ আইন ও নীতিমালা থাকলেও শিশুদের প্রতি সহিংসতা কমছে না। প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, কন্যাশিশুদের প্রতি সহিংসতার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কোনো কার্যকর পর্যবেক্ষণ বা নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি থাকার কথা, কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে তা নেই। স্থানীয় প্রশাসনের তদারকি দুর্বল, শিশু সুরক্ষা কমিটিগুলো নিষ্ক্রিয়, আর সমাজকল্যাণ বিভাগে পর্যাপ্ত বাজেট বা প্রশিক্ষিত জনবল নেই।

বাংলাদেশে কন্যাশিশুর নিরাপত্তা আজ শুধু শারীরিক নয়, ডিজিটাল পরিসরেও বিপন্ন। বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, পারিবারিক সহিংসতা তো বটেই, এখন তারা অনলাইনে যৌন হয়রানি ও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে অকার্যকর আইন, তার প্রয়োগে শৈথিল্য এবং সামাজিক দায়বোধের অভাব।

রাষ্ট্র যদি সত্যিই শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়, তবে কেবল পুলিশি বা আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা নয়, পাশাপশি সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার জায়গাটি নিয়ে ভাবতে হবে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা ধর্মীয় সংগঠনÑ সব জায়গায় বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় লিঙ্গ সংবেদনশীলতা বাড়াতে পাঠ্যপুস্তকে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। সর্বাপরি পরিবারে, সমাজে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কন্যাশিশুর প্রতি সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ফেরদৌস আরা রুমী : লেখক ও অধিকারকর্মী

মতামত লেখকের নিজস্ব