রাজনৈতিক ঐক্যই চ্যালেঞ্জ

জুলাই সনদ

সম্পাদকীয়
৩১ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৫৭
শেয়ার :
রাজনৈতিক ঐক্যই চ্যালেঞ্জ

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সম্প্রতি ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল সংবিধান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে একটি নতুন ও কার্যকর রাজনৈতিক পথনির্দেশ তৈরি করা। কিন্তু প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরই রাজনৈতিক অঙ্গনে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিশেষত দলগুলোর ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট বাদ পড়া, গণভোটের সময় ও পদ্ধতি স্পষ্ট না থাকা এবং কিছু প্রস্তাবের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে মতভেদের কারণে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে- এই সনদ সত্যিই কি ঐকমত্যের প্রতিফলন, নাকি তা অনৈক্যের নতুন রূপ?

প্রথমেই বলা দরকার, কমিশনের কাজের মূলে ছিল জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা এবং সংস্কারপ্রক্রিয়াকে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করা। ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে তিন দফা আলোচনার পর ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি হয়, যার মধ্যে ৪৮টি সংবিধান-সম্পর্কিত। এ পর্যন্ত ২৫টি দল সনদে সই করেছে, তবে শুরু থেকেই কিছু দল নির্দিষ্ট বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। বিশেষ করে সরকারের কাছে জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সেই নোট অব ডিসেন্ট বাদ পড়ে গেছে। এ কারণে বিএনপি বলছে, কমিশন প্রতারণা করেছে এবং ঐকমত্যের নামে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।

কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে যে অসংগতিগুলো উঠে এসেছে, তার একটি বড় দিক হলো গণভোটের সময় ও পদ্ধতি। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন পাবে। তবে কখন গণভোট হবে- নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে, নাকি তার আগে- সেই সিদ্ধান্ত সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই অস্পষ্টতা রাজনৈতিক সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। জামায়াত বলেছে, ‘বল চলে গেছে সরকারের কোর্টে।’ অর্থাৎ, গণভোটের তারিখ ও প্রক্রিয়া এখন সরকারের রাজনৈতিক সুবিধানির্ভর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরেকটি বড় বিতর্কিত প্রস্তাব হলো ২৭০ দিনের বাধ্যবাধকতা। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, আগামী সংসদ যদি এই সময়ের মধ্যে সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন করতে না পারে, তবে সংস্কার প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে। এটি শুধু সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, বরং সংসদীয় গণতন্ত্রকে আঘাত করে। সংসদকে একটি মুক্ত বিতর্ক ও আলোচনার ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হয়- যেখানে মতানৈক্য, যুক্তিতর্ক ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই নৈতিক বৈধতা জন্ম নেয়। সেই জায়গায় নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরোলেই প্রস্তাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে গৃহীত হবে- এমন প্রক্রিয়া গণতন্ত্রের পরিপন্থি।

বিএনপি বলছে, তারা যেসব বিষয়ে একমত ছিল না, সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। সেটি বাদ দেওয়া মানে ঐকমত্য নয়, প্রতারণা। গণসংহতি আরও স্পষ্টভাবে বলেছে, সংবিধান স্থগিত বা বাইপাস করে কিছু চাপিয়ে দিলে তা কার্যকর হবে না। এই বক্তব্যগুলো একদিকে সরকারের ওপর রাজনৈতিক অবিশ্বাসকে সামনে নিয়ে এসেছে, অন্যদিকে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।

তবে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কমিশনের প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। তাদের মতে, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারপ্রক্রিয়ায় একটি কার্যকর ভিত্তি তৈরি করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- একটি জাতীয় সনদ তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা সর্বসম্মত বা অন্তত গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের ঐকমত্যের প্রতিফলন ঘটায়। যদি প্রক্রিয়ার ভেতরেই বড় দলগুলোর আপত্তি উপেক্ষা করা হয়, তাহলে সনদটি ঐক্যের বদলে বিভেদের কারণ হয়ে উঠবে।

জোর করে সংস্কার চাপিয়ে দিলে তা টেকসই হবে না। এ কথা ইতিহাস বহুবার প্রমাণ করেছে। ২৭০ দিনের মতো সময়সীমা নির্ধারণ, গণভোটের অস্পষ্টতা কিংবা ভিন্নমত গোপন করা- এ সবই সংস্কারের নৈতিক বৈধতা খর্ব করে।

অন্তর্বর্তী সরকার, ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন বুঝতে হবে- সংস্কার মানে কেবল নতুন আইন নয়; এটি পারস্পরিক আস্থা পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া। আর সেই আস্থা তৈরি হবে শুধু উন্মুক্ত আলোচনা, স্বচ্ছতা ও জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে।