স্বপ্নের বদলে সর্বনাশ
একটা সময় ছিল যখন যুবকরা স্বপ্ন দেখত ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার, শিল্পী হওয়ার, দেশ গড়ার কারিগর হওয়ার। আজ তাদের একটা বড় অংশ স্বপ্ন দেখে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার। কিছুদিন আগেও যে ছেলেটি টিউশনি করে বা ছোট চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখত, এখন সে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু সেই স্বপ্নের রঙ তো মেকি, তাতে রঙতুলি হলো জুয়ার বিষাক্ত ছোবল। তারা বুঝতে পারে না, যে জুয়ার নেশায় আজ তারা বুঁদ হয়ে আছে সেটা কোনো সোনালি হাইওয়ে নয়; একটি অন্ধকার টানেল, যার শেষ প্রান্তে অপেক্ষা করছে শুধুই ধ্বংস, সর্বনাশ আর অসীম অন্ধকার। বাংলাদেশের শহর ও গ্রাম- দুই জায়গাতেই এই প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষ করে বেকার যুবকদের মধ্যে জুয়ার প্রতি আকর্ষণ ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চাকরি নেই, আয় নেই, অথচ মোবাইল আছে, ইন্টারনেট আছে, আর আছে ‘দ্রুত ধনী হওয়ার’ এক বিভ্রম। এককালে যেখানে জুয়াড়িদের আড্ডা হতো অন্ধকার ঘরে, লুকিয়েচুরিয়ে, আজ সেখানে সুন্দর করে ডিজাইন করা অ্যাপ, প্রলোভনসংকুল অফার আর ‘বিনিয়োগের বিকল্প’-এর মোহনীয় মোড়কে সাজানো এক ভয়ংকর ফাঁদ। এখন জুয়া চলে প্রকাশ্য দিবালোকে, সবার চোখের সামনে, তাদের হাতের মুঠোয়। বাসে, চায়ের দোকানে, এমনকি ক্লাসরুমে বসেও ছেলেগুলো বাজি ধরছে। কিসের বাজি? ক্রিকেট খেলা, ফুটবল ম্যাচ, অনলাইন গেম- সবকিছুতেই চলছে টাকার খেলা। শুরু হয় অল্প অল্প করে, একটু উৎসুকতায়, বন্ধুদের প্ররোচনায়, আবেগে বা শুধুই সময় কাটানোর নামে। এক ক্লিকে শুরু হয় এক বিভ্রম, যা শেষ হয় নিঃস্বতায়। এই জালে আটকা পড়লে বের হওয়ার পথ ক্রমেই সংকীর্ণ হতে থাকে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এটি এমন এক গ্রাসকারী চক্রের জন্ম দেয়, যেখানে বিজয়ের উত্তেজনা এবং পরাজয়ের হতাশার দোলাচলে আটকা পড়ে যুবকরা। মস্তিষ্ক তখন ডোপামিন নামক রাসায়নিকের এক বিষাক্ত খেলায় মত্ত হয়। জেতার সময় যে ডোপামিন নিঃসরণ হয়, তা এমন এক আনন্দের সংকেত দেয় যা পুনরায় অনুভবের জন্য তারা আরও বেশি বেশি জুয়ায় মত্ত হয়। ভাবতে থাকে- এই তো সফলতা আর বেশি দূরে নয়। হারজিতের পালাবদলে সামনে আসে আসল সমস্যা। হারার বেদনা তাকে আরও ঝুঁকি নিতে প্ররোচিত করে, হারানো টাকাটা তুলে নেওয়ার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু এই চক্করে পড়ে সে নিজের বাকিটুকুও খসিয়ে দিয়ে হয়ে যায় নিঃস্ব-সর্বস্বান্ত। জুয়া শুধু টাকাই শেষ করে না, একটা মানুষকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়। যে ছেলেটি একসময় হাসিখুশি ছিল, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিত, এখন সে সারাক্ষণ টেনশনে ভোগে। বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। রাতে ঘুম হয় না। জুয়া খেলার টাকা জোগাড় করতে না পারলে সে চুরি-চামারি থেকে শুরু করে ছিনতাই, খুন পর্যন্ত করে। পাওনাদারদের ভয়ে ঘর ছেড়ে পালায়। অনেক সময় দেখা যায়, জুয়ার টাকা জোগাড় করতে না পেরে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে কেউ কেউ। এই ব্যক্তিগত ধ্বংসস্তূপের ছাই উড়ে যায় পরিবারের ওপর দিয়ে। মা-বাবার আজীবনের সঞ্চয়, বোনের গয়না, সংসারের জরুরি প্রয়োজনের টাকা- সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যায়।
পরিবারে শুরু হয় অবিশ্বাস, কলহ আর আর্থিক দুরবস্থার দুর্বিষহ জীবন। অনেক সময় এই ঋণের বোঝা পরিবারকেও দীর্ঘদিন টানতে হয়, তাদের স্বপ্নগুলোও ধূলিসাৎ হয়। কিন্তু এর প্রভাব তার চেয়েও সুদূরপ্রসারী। যখন একটি দেশের যুবশক্তি, দেশের যে মেরুদণ্ড, সে যখন জুয়ার নেশায় আক্রান্ত হয়, তখন তা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এক ভয়ংকর সংকটের জন্ম দেয়। একটি প্রজন্ম যে উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল হওয়ার কথা ছিল, তারা হয়ে পড়ে অলস, অসৎ ও হতাশাগ্রস্ত। সমাজে বাড়ে অপরাধ, বাড়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা। দেশের ভবিষ্যতের চালিকাশক্তি যখন নিজের ভবিষ্যৎই নষ্ট করছে, তখন জাতির সামগ্রিক অগ্রগতির গতিপথও ব্যাহত হয়।
আমাদের যুবসমাজকে রক্ষা করতে হবে, তাদের স্বপ্নকে বাঁচাতে হবে। না হলে এই জাতি হারাবে তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ- তার তরুণ শক্তি। শুধু আইন করলেই হবে না, দরকার মনোস্তাত্ত্বিক সহায়তা, পুনর্বাসনকেন্দ্র, সচেতনতা কর্মসূচি, আর সবচেয়ে বেশি দরকার তরুণদের আস্থার ভরসা।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
ইব্রাহীম খলিল সবুজ : শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি