মিয়ানমারের নির্বাচন ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

চিররঞ্জন সরকার
৩১ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৪৯
শেয়ার :
মিয়ানমারের নির্বাচন ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের সঙ্গে একটি জায়গায় মিয়ানমারের বিরাট মিল আছে। দুই দেশেই নির্বাচন বা ভোট দীর্ঘদিন ধরে মোটামুটি নির্বাসিত। দুই দেশেই শান্তি পুরস্কারে ভূষিত দুজন নোবেল লরিয়েট আছেন, যারা ক্ষমতার প্রাণকেন্দ্রে আছেন। তবে আমাদের চেয়ে মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্ভবত একটু বেশিই খারাপ।

দীর্ঘদিনের দমন, বিদ্রোহ আর অনিশ্চয়তার পর আবারও নির্বাচন হতে যাচ্ছে মিয়ানমারে। কাগজে-কলমে এটি একটি ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’, কিন্তু বাস্তবে তা যেন এক নিস্তেজ নাটক- যেখানে ফলাফল আগেই লেখা, অভিনেতারা বন্দি বা নির্বাসিত, আর দর্শক মাত্রই আতঙ্কিত নাগরিক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি আজ রক্তাক্ত বিভাজনের ওপরে দাঁড়িয়ে, যেখানে ভোট নয়, বন্দুকের নলই ঠিক করে কে শাসন করবে। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমার শুধু একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয়, বরং এক অস্থিতিশীল আগুনের গোলা- যার শিখা সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ে কক্সবাজার, বান্দরবান বা বঙ্গোপসাগরের জলসীমায়।

মিয়ানমারের ইতিহাসটি এক দীর্ঘ রাজনৈতিক বৃত্তের মতো, যা বারবার ঘুরেফিরে সামরিক নিয়ন্ত্রণেই এসে থামে। ১৯৯০ সালে অং সান সু চির দল এনএলডি নির্বাচনে জয়ের পরও ক্ষমতা পায়নি। ২০১৫ ও ২০২০ সালের নির্বাচনের পরও সেনারা সেই জনমতকে উল্টে দিয়েছে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এবারও দৃশ্যপট আলাদা নয়- সংবিধান অনুযায়ী এক-চতুর্থাংশ আসন বরাদ্দ সেনাদের জন্য, বাকি অংশেও তাদেরই দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) নিরঙ্কুশ প্রাধান্য পাবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। ভোট তাই এখানে কেবল বৈধতার এক পাতলা প্রলেপ।

কিন্তু এবার মিয়ানমারের বাস্তবতা আরও গভীরভাবে ভেঙে পড়েছে। দেশটির অর্ধেকের বেশি অঞ্চলই কার্যত গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত। রাখাইন, কাচীন, চীন, শান- সব প্রদেশে চলছে সশস্ত্র জাতিগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ। আরাকান আর্মি রাখাইন অঞ্চলের শহর ও বন্দরগুলো দখলে রেখেছে, কাচীন ইনডিপেনডেন্স আর্মি দখল করেছে উত্তরাঞ্চলের মূল্যবান জেড খনিগুলো, আর পূর্ব দিকে ওয়া স্টেট আর্মি প্রায় চীনের প্রোটেক্টরেটের মতো কাজ করছে। যে স্থানে সরকারি গাড়ির কনভয় থামে, সেখানেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায়। এমন এক ভগ্ন রাষ্ট্রে নির্বাচন মানে প্রহসন- ভয়, সহিংসতা আর দারিদ্র্যের মাঝে এক অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতা।

এই গৃহযুদ্ধের ধোঁয়া সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের দিকেও ছড়িয়ে পড়ে। কক্সবাজার ও বান্দরবানের পাহাড়ি সীমান্তে প্রায়ই শোনা যায় মিয়ানমারের গোলাগুলির শব্দ, কখনও কখনও গুলি এসে লাগে বাংলাদেশের ভেতরে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আবারও ভয়ের বাতাস বইছে, কারণ রাখাইনে আরাকান আর্মি ও সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ নতুন করে শরণার্থীর ঢল নামাতে পারে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে- যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শরণার্থী সংকট। এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের জন্য মানবিক, সামাজিক, এমনকি নিরাপত্তাজনিত এক বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের কূটনীতি চীনের মধ্যস্থতার ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু বাস্তবে বেইজিং কখনও সেনা প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়নি। তারা বরং মিয়ানমারে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে তেল-গ্যাস পাইপলাইন, খনিজ সম্পদ ও সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে। কোকো দ্বীপে চীনের নজরদারি ঘাঁটি, ইউনান থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত করিডর- সবই ইঙ্গিত দেয়, চীন ধীরে ধীরে মিয়ানমারকে তার ভূ-রাজনৈতিক বলয়ের অংশ বানাচ্ছে। জাতিসংঘের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এখানে আধিপত্য কায়েম করতে চাইছে। এই উপস্থিতি ভারতের জন্য যেমন কৌশলগত হুমকি, বাংলাদেশের জন্যও তেমনি এক বিপজ্জনক ইঙ্গিত।

বঙ্গোপসাগর এখন এক নতুন প্রতিযোগিতার মঞ্চ। চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হিসেবে এই অঞ্চলকে নিজের সামুদ্রিক রুটের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়, যাতে তেল ও বাণিজ্যপথ নিরাপদ থাকে। অন্যদিকে ভারতও ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির আওতায় মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছাতে চায়। কিন্তু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্পসহ ভারতের বিভিন্ন সংযোগ পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এর ফলে ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংযোগ উদ্যোগগুলোও জটিলতায় পড়ছে।

বাংলাদেশের অবস্থান এই ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে অত্যন্ত সূক্ষ্ম। একদিকে মানবিক দায়িত্বে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে হয়েছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক চাপ ও সীমিত সম্পদের কারণে তা টেকসই হয়ে উঠছে না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দারিদ্র্য, অপরাধ, চোরাচালান ও উগ্রপন্থার ছায়া ঘন হচ্ছে- যা সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। তা ছাড়া রাখাইন প্রদেশে চীনের বিনিয়োগ, বিশেষ করে কিয়াউকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প, বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরীয় স্বার্থকেও প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশ যদি সেখানে সক্রিয় কূটনৈতিক উপস্থিতি না রাখে, তবে সে তার দক্ষিণ দিকের কৌশলগত ক্ষেত্র হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।

কিন্তু শুধু পররাষ্ট্রনীতি নয়, মিয়ানমারের সংকট বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার প্রতিও এক পরোক্ষ আঘাত। এখানে অপরাধীচক্রের প্রভাব বেড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা ধীরে ধীরে কমছে, ফলে বাংলাদেশকে নিজস্ব বাজেট থেকেই রোহিঙ্গাদের খরচ বহন করতে হচ্ছে- যা অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। একই সঙ্গে, রাখাইনের অস্থিরতা সীমান্তে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান বাড়িয়েছে। ইয়াবা পাচারের রুট এখন অনেকাংশে এই সংঘর্ষপূর্ণ এলাকা হয়ে গেছে। এর ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল নিরাপত্তাহীনতার দোলাচলে রয়েছে।

ভূ-রাজনীতির বড় পরিসরে দেখা যায়, মিয়ানমারের সংকট আসলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক নতুন ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরির যুদ্ধক্ষেত্র। চীন তার প্রভাব বিস্তার করছে অবকাঠামো ও অস্ত্র সহযোগিতার মাধ্যমে, রাশিয়া অস্ত্র বিক্রি করে অর্থনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে, আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে- কিন্তু বাস্তব পরিবর্তন আনতে পারছে না।

এই বিভাজনের সুযোগ নিয়েই জান্তা সরকার নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে। তারা জানে, কেউই মিয়ানমারকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না- কারণ দেশটি কৌশলগতভাবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের হাতে রয়েছে তেল-গ্যাস পাইপলাইনের নিয়ন্ত্রণ, সমুদ্রবন্দর, রেয়ার আর্থ মিনারেল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগের সেতু। তাই সামরিক শাসকরা ‘ভয় ও বৈধতার কৃত্রিম মিশ্রণ’ দিয়ে শাসন চালিয়ে যেতে পারছে।

বাংলাদেশের জন্য এখন বড় প্রশ্ন- এই বাস্তবতার মধ্যে তার কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা অবস্থান কী হবে। সেনা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাও ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ আন্তর্জাতিকভাবে তারা বিতর্কিত। আবার সম্পর্ক ছিন্ন করলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চীন, ভারত ও আসিয়ান- তিন দিকেই সমন্বিত কূটনৈতিক পথ খোঁজার চেষ্টা করছে। বেইজিংয়ের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চাপ সৃষ্টি, দিল্লির সঙ্গে সীমান্ত সহযোগিতা এবং আসিয়ানের মাধ্যমে মানবিক সংলাপ- এই ত্রিমাত্রিক কৌশলই হতে পারে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত। একই সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো, শরণার্থী ক্যাম্পে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর কার্যক্রম রোধ করা এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সংকটকে বহুপক্ষীয় আলোচনায় তোলা- এ সবই বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার অপরিহার্য অংশ।

বাংলাদেশের জন্য এখন সময় এসেছে মিয়ানমারের দিকে ‘সমস্যা’ নয়, বরং ‘পরিবর্তনশীল বাস্তবতা’ হিসেবে তাকানোর। কারণ রোহিঙ্গা সংকট, সীমান্ত নিরাপত্তা, ভূ-রাজনীতি- সবকিছুই আজ এক সূত্রে বাঁধা। ঢাকার কূটনীতিকে তাই আরও প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে- সংযম, বাস্তববোধ ও আঞ্চলিক সহযোগিতার সূক্ষ্ম মিশ্রণে। মিয়ানমারের গুলির শব্দ শুধু সীমান্তের ওপারে নয়, তা প্রতিধ্বনিত হয় বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ভেতরেও। আর সেই প্রতিধ্বনি শুনে এখনই প্রস্তুত হতে হবে- যাতে আগুনের এই ছায়া আমাদের আকাশে না ছড়িয়ে পড়ে।


চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক

মতামত লেখকের নিজস্ব