নজরদারি ও শাস্তি নিশ্চিত করুন

জ্বালানি তেলে ভেজাল

সম্পাদকীয়
৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫২
শেয়ার :
নজরদারি ও শাস্তি নিশ্চিত করুন

দেশের জ্বালানি তেলের বাজারে ভেজাল তেল বিক্রি এবং মাপে কম দেওয়ার ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক এক গভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে না, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্যও হুমকি সৃষ্টি করছে। তেলের মান খারাপ হওয়ার কারণে গাড়ি ও মোটরসাইকেলের ট্যাংকে মরিচা পড়ছে, পাম্পের ট্যাংকও ক্ষয় হচ্ছে, যা একদিকে ভোক্তাদের ক্ষতি করছে এবং তেল ব্যবসার স্বচ্ছতা ও মানুষের আস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।

উদ্বেগের বিষয় হলো, অভিযান পরিচালনা করা হলেও সমস্যার মূল উৎস চিহ্নিত ও প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। বরং অভিযোগ রয়েছে, এই চক্রে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরের কিছু মানুষ জড়িত থাকার কারণে অপরাধীরা দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ডিপো থেকে সরাসরি ভেজাল তেল ফিলিং স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছানোর ঘটনাও ঘটছে।

সম্প্রতি একটি বৈঠকে জ্বালানি সচিব নির্দেশ দিয়েছেন যে, ভেজাল তেল বিক্রির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে বেশি অভিযান পরিচালনা করা এবং বিপিসিকে নিয়মিত তদারকি করার কথা বলা হয়েছে। এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলমান সমস্যার জটিলতা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, কেবল নির্দেশনা যথেষ্ট নয়।

সেপ্টেম্বর মাসে মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী জেলায় বিপিসি পরিচালিত অভিযানে আটটি ডিসপেন্সিং ইউনিট থেকে ১,২০০ লিটার ডিজেল এবং ৩৮০ লিটার অকটেন জব্দ করা হয়। এ ছাড়াও দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই অভিযানগুলো ভেজাল তেল চক্রের সামান্য অংশকে উন্মোচন করেছে। কিন্তু এর চেয়ে বড় সমস্যা হলো অপরাধীরা ধীরে ধীরে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

দুর্ভাগ্যবশত, এই চক্রের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেই। সরকারি উচ্চ পর্যায়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি রিপোর্ট করলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রায় দেড় দশক ধরে বিভিন্ন অভিযান ও জরিমানা সত্ত্বেও ভেজাল তেল বিক্রি রোধ করা যায়নি। এটি শুধুই প্রশাসনিক ত্রুটি নয়, বরং পুরো তেল বিপণন ব্যবস্থার অপ্রযুক্তিগত ও অস্বচ্ছ প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে।

বর্তমানে তেল বিপণন প্রক্রিয়া প্রায় সম্পূর্ণভাবে ম্যানুয়াল। এর ফলে নিয়মিত নজরদারি বা স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রযুক্তির অভাব অপরাধীদের জন্য সুযোগ তৈরি করছে। সঠিক ট্র্যাকিং ব্যবস্থা ও মান নিয়ন্ত্রণের অভাবে চোরচক্র সহজে কাজ চালাতে পারছে। স্থানীয় প্রশাসন ও ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়মিত অভিযান চালালেও তাদের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নেই, যা সমস্যার মূল কারণ।

এই চক্র বন্ধ করতে হলে একটি সমন্বিত, প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা অপরিহার্য। কেবল অভিযান ও জরিমানা যথেষ্ট নয়। স্বচ্ছ ও নিয়মিত মনিটরিং, ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেম, কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং তেল সরবরাহ প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ অডিট ও মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভেজাল তেলের এই সমস্যা কমানো সম্ভব। অভিযান পরিচালনার পরে ফলাফলও প্রকাশ করা উচিত।

জনসচেতনতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটির মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো হলে জনগণও সতর্ক থাকবে এবং অপরাধীরা জনচক্ষে থাকায় তাদের কার্যক্রম সীমিত হবে। ভেজাল তেল পরিবেশের জন্যও দীর্ঘ মেয়াদে মারাত্মক হুমকি। তাই বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রশাসনিক নির্দেশনা দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়।

মূলত ভেজাল তেল চক্র বন্ধ না করলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, পরিবেশ এবং নাগরিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি স্থায়ী হুমকি হয়ে থাকবে। সময় এসেছে সরকারের, প্রশাসনের ও নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার, যাতে তেলের বাজারে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা যায় এবং সাধারণ মানুষ সুরক্ষিত ও মানসম্পন্ন জ্বালানি পেতে পারে।