চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া জাতীয় স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত: আনু মুহাম্মদ

এমিলিয়া খানম
৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৫২
শেয়ার :
চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া জাতীয় স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত: আনু মুহাম্মদ

আনু মুহাম্মদ প্রখ্যাত শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও লেখক। দীর্ঘদিন ধরে তিনি দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, জ্বালানি ও উন্নয়ননীতি নিয়ে কাজ করে আসছেন। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অবস্থা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দৈনিক আমাদের সময়ের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের সময়-এর সহকারী সম্পাদক- এমিলিয়া খানম

আমাদের সময় : চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি টার্মিনালের পরিচালন দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

আনু মুহাম্মদ : চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত। এটি প্রমাণ করে সরকার জনগণের মতামত বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ কোনোটিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। দরপত্র ছাড়া, আলোচনা ছাড়া, একতরফাভাবে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আগের সরকারও একইভাবে এমন চুক্তি করতে চেয়েছিলেন, সেটি অসমাপ্ত ছিল- এ সরকার এখন সেই কাজ জোর করে শেষ করতে চাইছে। এমনকি এ নিয়ে প্রতিবাদও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এক মাসের জন্য বন্দর এলাকায় সভা-সমাবেশ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এবং জবাবদিহিহীন আচরণ।

দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিদেশি কোম্পানি আনা হচ্ছে। এই যুক্তি একেবারেই ভিত্তিহীন। চট্টগ্রাম বন্দর এখন লাভজনক প্রতিষ্ঠান। ব্যয়ের তুলনায় আয় বহুগুণ বেশি। অর্থাৎ এটি অদক্ষ নয়, বরং দক্ষভাবে চলছে। দক্ষতা বাড়াতে হলে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা যায়, বিদেশি বিশেষজ্ঞ আনা যায়- এসবের কোনো বাধা নেই। কিন্তু সরকার সেগুলো না করে বিদেশি অপারেটর আনতে চাচ্ছে, যা প্রকৃতপক্ষে অন্য স্বার্থে পরিচালিত। বন্দরের যে বিলম্ব বা জটিলতা আছে, তার মূল কারণ কাস্টমস, আমলাতন্ত্র ও দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থা। এগুলো ঠিক না করে বিদেশি কোম্পানিকে আনা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। আবার অন্যদিকে সরকার মাশুলও বাড়াচ্ছে।

আমাদের সময় : মাশুল বাড়ানোর কারণ কী?

আনু মুহাম্মদ : মাশুল বাড়ানোর প্রকৃত কারণ হলো বিদেশি কোম্পানির মুনাফা নিশ্চিত করা। যখন বিদেশি প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নেবে, তারা যেন সহজে মুনাফা তুলতে পারে এবং দায় না নিতে হয়- সেই সুবিধা আগেভাগে তৈরি করে দিচ্ছে সরকার। এর ফলে আমদানি-রপ্তানি খরচ বাড়বে, পণ্যের দাম বাড়বে, ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে- অর্থাৎ পুরো অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হবে।


আমাদের সময় : অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ফুলবাড়ী কয়লাখনি দেখিয়ে এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) লন্ডনে শেয়ার ব্যবসা করছে প্রায় ২০ বছর ধরে। আগের কোনো সরকারই এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?

আনু মুহাম্মদ : এটা অনেকটা আমাদের দেশের টাউটদের মতো। কিছু টাউটা আছে দেখবেন আরেকজনের বাড়ি বা জমি দেখিয়ে কেনাবেচা করে। দলিল জালিয়াতি করে। এশিয়ান এনার্জি ঠিক সেই কাজটা করছে। এটি এক ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতারণা। ফুলবাড়ী নিয়ে জনগণের সঙ্গে ছয় দফা চুক্তি হয়েছিল- যার মধ্যে স্পষ্ট বলা আছে, উন্মুক্ত খনি হবে না এবং এশিয়া এনার্জিকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। কিন্তু তারা এখনও লন্ডনে ‘গ্লোবাল কোল’ নামে ব্যবসা করছে। তাদের কোনো বৈধ চুক্তি নেই, তবু তারা শেয়ার মার্কেটে মুনাফা করছে- এটা সম্ভব হচ্ছে দেশের ক্ষমতাবানদের অংশীদারিত্বের কারণেই। আমরা বহুবার সরকারকে অনুরোধ করেছি এ শেয়ার ব্যবসা বন্ধ করতে ও আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে, কিন্তু আজও তা হয়নি।

আমাদের সময় : রামপাল, রূপপুর, মাতারবাড়ী- এসব বিদ্যুৎ প্রকল্প আপনি কেন ‘প্রাণবিনাশী প্রকল্প’ বলে আসছেন?

আনু মুহাম্মদ : কারণ এগুলো মানুষ, প্রকৃতি এবং দেশের নিরাপত্তা- সবকিছুর জন্য বিপদ ডেকে আনছে।

রামপাল প্রকল্প সরাসরি সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে, যেখানে কোটি মানুষের জীবন নির্ভর করে। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে ঘনবসতিপূর্ণ, নদী-খাল-বিল ঘেরা অঞ্চলে- যেখানে সামান্য দুর্ঘটনাও ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটাতে পারে।

আমরা ২০১৭ সালে বিকল্প পরিকল্পনা দিয়েছিলাম- যেখানে কয়লা বা পারমাণবিক জ্বালানির বদলে নিজস্ব গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের প্রস্তাব ছিল। তাতে খরচও কম, পরিবেশও বাঁচে। কিন্তু সরকার তা শোনেনি। এ সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু তারা এখনও আগের প্রাণবিনাশী প্রকল্পগুলোই চালিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সময় : বিদেশি কোম্পানিনির্ভর, ঋণনির্ভর, আমদানিনির্ভর নানা চুক্তি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ এখতিয়ার কি অন্তর্বর্তী সরকারের আছে? মার্কিন কোম্পানি থেকে এলএনজি আমদানির চুক্তি কি পেট্রোবাংলাকে জানিয়ে হয়েছে?

আনু মুহাম্মদ : বর্তমান সরকারের মধ্যে এমন কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন, যারা বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থরক্ষায় অস্বাভাবিক উৎসাহ দেখাচ্ছেন। আগের সরকার যখন ঋণনির্ভর, প্রকৃতিবিনাশী এবং বিদেশি স্বার্থনির্ভর নানা চুক্তি করছিল, তখন সেটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। বর্তমান সরকার সেই সময়ের অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তারাও একই পথে হাঁটছে; বরং আরও অস্বচ্ছভাবে। উদাহরণ হিসেবে- সরকারের এক বিশেষ সহকারী সম্প্রতি এলএনজি আমদানির একটি চুক্তি সম্পন্ন করেছেন, অথচ রাষ্ট্রীয় সংস্থা পেট্রোবাংলা পর্যন্ত সে বিষয়ে অবগত নয়। এর মাধ্যমে সরকারের অভ্যন্তরে স্বচ্ছতার ঘাটতি ও জবাবদিহির অভাব স্পষ্ট হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তুলনামূলক কম দামে পণ্য পাওয়া গেলেও সরকার নানা রাজনৈতিক বিবেচনায়- বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনকে খুশি করার উদ্দেশ্যে- গম, এলএনজি, মাছ-মাংস ও অস্ত্রসহ বিভিন্ন পণ্য অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে আমদানি করছে। এসব সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতির ওপর এক স্থায়ী বোঝা তৈরি করছে এবং ভবিষ্যতের জন্য গভীর অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনছে।

আমাদের সময় : আপনি কি অতীতের সব চুক্তি প্রকাশ করার পক্ষে?

আনু মুহাম্মদ : অবশ্যই। সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক- সব ধরনের চুক্তি প্রকাশ করতে হবে। না জানলে জনগণ বিচার করবে কীভাবে? বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি- এরা উন্নয়নের নামে আসলে বাংলাদেশে গ্যাস রপ্তানি, শিক্ষা-চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণ, চিনি ও রেল খাত ধ্বংসের মতো ক্ষতিকর নীতি চাপিয়ে দিয়েছে। এসব চুক্তির জবাবদিহি না থাকায় আমরা তাদের করুণার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি।

আমাদের সময় : সাম্প্রতিক সময়ে গান, নাটক, মেলা, পাঠাগার বা মেয়েদের খেলাধুলা- সবকিছু হুমকির মুখে। আপনি এ অবস্থাকে কীভাবে দেখছেন?

আনু মুহাম্মদ : এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শেখ হাসিনার পতনের পর কিছু উগ্র ও সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়েছে- তারা শিল্প-সংস্কৃতির শত্রু। মেয়েদের অংশগ্রহণ, সংগীত, নাটক, এমনকি ধর্মীয় ভিন্নধারার চর্চাও তারা সহ্য করতে পারছে না। এই সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর না হয়ে বরং নীরব থেকেছে, এ নীরবতা অনেক ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্যকেই বৈধতা দিচ্ছে। এটা জাতির জন্য বিপজ্জনক। তাছাড়া শিল্প-সংস্কৃতি ছাড়া কোনো সমাজ টিকে থাকতে পারে না।

আমাদের সময় : দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

আনু মুহাম্মদ : বর্তমানে অর্থনীতির কিছু ইতিবাচক দিক আছে। যেমন- রিজার্ভ সামান্য বেড়েছে, ব্যাংক লুটপাট আপাতত কমেছে। কিন্তু বেকারত্ব বেড়েছে, দারিদ্র্য বেড়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। শেখ হাসিনার পতনের পর দেখা গেল বেসরকারি খাতের দুর্নীতিপরায়ণ মালিকদের কারণে বহু কারখানা বন্ধ হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এগুলো চালু করা যেত, যেমন- মুক্তিযুদ্ধের পর পরিত্যক্ত কারখানাগুলো রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিল। সরকার সেটি করছে না। ফলে লাখো নতুন বেকার তৈরি হয়েছে।

বর্তমানে যেসব বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান চলছে, যেমন- এস আলম গ্রুপ বা সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠানগুলো- এগুলো আসলে জনগণের টাকায় গড়া, ঋণনির্ভর প্রতিষ্ঠান। এগুলো পরিচালনায় সরকারের দায়িত্ব ছিল সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। কিন্তু তা না করায় বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বেড়েছে বেকারত্ব। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দারিদ্র্যের ওপর। গত এক বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমার কথা থাকলেও বরং আরও বেড়ে গেছে।

প্রধান উপদেষ্টা সারা বিশ্বে ‘শূন্য দারিদ্র্য’ নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন, অথচ তার দায়িত্বে থাকাকালেই দেশে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দুটোই বেড়েছে। ব্যাংক খাত প্রায় ধ্বংসের মুখে। অনেক ব্যাংক কার্যত দেউলিয়া হয়ে গেছে। অথচ সরকার সেই ব্যাংকগুলো বাঁচাতে জনগণের অর্থ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করছে- যেগুলোর অস্তিত্বই থাকার কথা নয়। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

অন্যদিকে, সরকারি আমলাদের বেতন বাড়ানোর আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি- যেমন বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা মেটাতে তাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র জনগণের চাহিদার চেয়ে ক্ষমতাবানদের সুবিধাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এখন যেখানেই সমাবেশ হচ্ছে, দেখবেন কর্মসংস্থানই মূল দাবি। সেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শ্রমিক- সবাই একসঙ্গে। সরকার যদি সত্যিই জনগণের সরকার হতো, তাহলে এসব দাবি মনোযোগ দিয়ে শুনত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, যখন শ্রমিক বা শিক্ষকরা ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করেন, তখন তাদের ওপর পুলিশি দমননীতি চালানো হয়, গুলিতে শ্রমিক নিহত হন। অথচ যখন মাফিয়া বা দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য চলে, তখন সরকার নীরব থাকে। সরকার যদি এখনই কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য হ্রাস, ব্যাংক সংস্কার ও জবাবদিহিমূলক অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ না করে, তবে সংকট আরও গভীর হবে।

আমাদের সময় : বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি কীসে?

আনু মুহাম্মদ : মুক্তি মানে দেশের ওপর দেশের মানুষের মালিকানা প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ থাকতে হবে এবং চারটি বৈষম্যের (শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতিগত ও ধর্মীয়) অবসান ঘটাতে হবে। যে দল বা সরকার এই বৈষম্য কমানোর কর্মসূচি দেবে, তারাই প্রকৃত অর্থে জনগণের পক্ষের শক্তি। বৈষম্য টিকিয়ে রাখার রাজনীতি যতদিন চলবে, ততদিন মুক্তি আসবে না।

আমাদের সময় : ধন্যবাদ! আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য।

আনু মুহাম্মদ : ধন্যবাদ।