বিনিয়োগ আস্থা বাড়াতে হবে
একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো বিদেশি বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে একটি দেশ রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। দেশের বাইরের কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানি যখন আমাদের দেশে অর্থ বিনিয়োগ করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে, তখন আমাদের দেশের অর্থনীতি আরও সচল হয়ে ওঠে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন হয়, বেকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশীয় কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতেও সহায়তা করে থাকে। এতে অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন খাতের অবকাঠামো উন্নয়নেও বিদেশি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় দেশে নানা সংকট দেখা দেয়। অর্থনীতিতে কিছুটা ধস নেমে আসে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষের কর্মসংস্থান কমে যায়। এতে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগে আবারও সুদিন ফিরতে শুরু করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত মোট প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক। এ জন্য দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ যাতে আরও বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর তার জন্য দেশের নীতিনির্ধারণী মহলসহ সংশ্লিষ্টদের আরও সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনও যেসব জায়গায় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। নিরাপদ ও লাভজনকভাবে তারা যেন কাজ করতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
সাধারণত বাইরে থেকে কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানি সব সময় লাভজনক ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে চায়, যেখানে বিনিয়োগ করলে তারা সহজে এবং অনেকটা নিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে লাভবান হতে পারবে। আর বিশেষ করে তারা বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করে থাকে, যেখানে বিনিয়োগে ঝুঁকি কম থাকে। যখন তারা দেখে বিনিয়োগ করলে ব্যবসায় ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে কিংবা সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট অনুকূল পরিবেশ নেই তখন তারা বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তারা সেসব দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে যখন বিনিয়োগের একাধিক বিকল্প জায়গা থাকে, তখন তারা পছন্দমতো দেশ নির্বাচন করে সেখানে বিনিয়োগ করে। যেহেতু সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের দেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছে, সেহেতু তাদের এই আস্থার জায়গাটা আমাদের যেকোনো মূল্যে ধরে রাখতে হবে। কোনো সংকট বা বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে যাতে তারা নিরুৎসাহিত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আমরা দেখেছি, বিগত বছরগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে যেসব খাতে তার মধ্যে অন্যতম হলো পোশাকশিল্প এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, যে খাতে উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানি পণ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি আমরা বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে পেরেছি। এ জন্য এসব খাতে তারা যাতে পরবর্তী সময়ে আরও বেশি বেশি বিনিয়োগ করে সে জায়গায় আমাদের কাজ করতে হবে। একটি সূত্র বলছে, এ বছর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটের মতো কিছু আয়োজনে পোশাক ও টেক্সটাইল খাতে নতুন কিছু বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে, যার ফলে আমাদের উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও এগিয়ে যাব। আন্তর্জাতিকভাবে পোশাকশিল্পের বাজার আরও সমৃদ্ধ হবে। সর্বোপরি আমাদের পোশাকশিল্পের জন্য এমন ঘোষণা দেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৬৭০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার, যা পরবর্তী ২০২৩ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৯২৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার। তবে ২০২৪ সালে এই বিনিয়োগের পরিমাণ কিছুটা কমে এসে ৬৭৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। কিন্তু সর্বশেষ ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে আবার বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে গিয়ে ১ হাজার ৯২ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ধীরে ধীরে বিদেশি বিনিয়োগে আমাদের সুদিন ফিরতে শুরু করেছে। বৈশ্বিক মন্দার ভেতরেও বাংলাদেশে তাদের এই বিনিয়োগ আস্থার প্রতিফলন হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সরকারি-বেসরকারি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। আমরা জানি, আমাদের দেশে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিদেশি বিনিয়োগের অন্যতম অন্তরায়। এ জন্য দুর্নীতি ঠেকাতে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিনিয়োগকারীরা যাতে সহজে ও দ্রুত সময়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন তার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। তারা যাতে ব্যবসায়িক লভ্যাংশ সহজ প্রক্রিয়ায় নিয়ে যেতে পারেন তার জন্য অনলাইন বা ডিজিটাল সেবা চালু রাখতে হবে। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। তাদের বিনিয়োগ করা কোনো প্রতিষ্ঠানে সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা দেখা দিলে তা দ্রুততার সঙ্গে সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। সর্বোপরি আমরা আশা রাখি, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আরও উৎসাহিত করতে বিনিয়োগবান্ধব আইনি পরিবেশ তৈরিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর আরও বেশি সচেতনতা অবলম্বন করবে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
রিয়াদ হোসেন : শিক্ষার্থী, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি