সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে সতর্কতা প্রয়োজন

গাজী তানজিয়া
২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৫৭
শেয়ার :
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে সতর্কতা প্রয়োজন

বর্তমানে সারা বিশ্বে সোশ্যাল মিডিয়া শক্তিশালী এক মাধ্যম। সামাজিক গমাধ্যম জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে সন্দেহ নেই। বিশ্বজুড়ে নানা দেশে এমনকি প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও এটি বড় প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। আমাদের মতো দেশে যেখানে এই কিছুদিন আগেও এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে, সেখানে রাজনীতির নেতিবাচক অনুশীলন থেকে মুক্তি ঘটেনি। বল প্রয়োগের ক্ষমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজনীতি এখনো চলমান। যা ছিল কিছুকাল আগে ক্ষমতাসীন দলের সংস্কৃতি, তা এখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মতবাদে বিশ্বাসীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ সামাজিক মাধ্যমের অসংখ্য ইতিবাচক দিকও রয়েছে। যার প্রভাব আমরা ’২৪-এর আন্দোলনে দেখেছি। একটি নির্দিষ্ট জনমত ও যুক্তি যেখানে অকার্যকর। ভিন্নমত ও বিবাদের মীমাংসা যেখানে পক্ষপাতমূলক, সেখানে সামাজিক মাধ্যম প্রায়ই জনকল্যাণে কাজ করে থাকে। অনেক ঘটনারই ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে সামাজিক মাধ্যমের জনমত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ এই মাধ্যম অনেক বেশি অংশগ্রহণমূলক। অ্যাক্টিভিজম অনেক বেশি সহজ এবং সে অর্থে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। আবার কিছু কিছু দুর্ঘটনার জন্যও সামাজিক মাধ্যমের দায় থেকে যায়। যেমন, আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু নেতিবাচক ঘটনা এর দায় এড়াতে পারে না।

তাই একটি অনগ্রসর সমাজে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে জাজমেন্টাল জনমত বা জনরোষ সৃষ্টিতে সোশ্যাল মিডিয়া নেতিবাচক হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করতে পারে। এ সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন একটি ঘটনার অবতারণা করেছেন। তিনি তার স্মৃতি গ্রন্থ ‘জগৎ কুটিরে’ তার শৈশবের বার্মার সঙ্গে বর্তমান মিয়ানরের কোনো মিল খুঁজে পাননি। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার শৈশবের দেখা বর্মি জনগণের স্বভাবের কোনো মিল নেই। বর্মি জনগণের যে দয়ার্দ্র ও উষ্ণ হৃদয়ের স্মৃতি তার হৃদয়ে গেঁথে আছে এটা ঠিক কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি তার বন্ধু জন হপকিনস স্কুল অব মেডিসিনের ‘ব্যাকপ্যাক’ রিসার্সার অ্যাডাম রিচার্ডস যিনি মিয়ানমারের স্বাস্থ্যসেবায় একসময় নিয়োজিত ছিলেন, তার মতামত নিয়েছিলেন। তার মতেও বর্মিরা সব সময় হাসিখুশি থাকে এবং গান গাইতে থাকে। তখন অমর্ত্য সেন চিন্তিত হয়ে ভাবলেন, ‘পরিবর্তনটা তাহলে কোথায় ঘটে গেল যে ব্যাপারটা এত বড় পার্থক্য তৈরি করল! সেটা হয়তো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নিরন্তর অপপ্রচার। এই অপপ্রচারের ফলে সুভদ্র বর্মিরা হয়ে উঠল হিংস্র ও ঘৃণাবর্ষী। এই রূপান্তরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী ভূমিকা আছে। ভূমিকা হলো, মানুষের মনকে বিষবাষ্পে ভরিয়ে তোলার। সুসংগঠিত জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর এবং অত্যাচার ও হত্যার জন্য ধর্মান্ধতার সশস্ত্র ব্যবহার।’ একই সঙ্গে অং সান সু চির একপেশে নীরবতা। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কুৎসিত প্রচার যুদ্ধে যারা জোরদার ভূমিকা নিয়েছিল তাদের অন্যতম ‘ফেসবুক’ বলে তিনি মনে করেন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মারাত্মক আক্রমণ চালাতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী কীভাবে ফেসবুকে যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে কাজে লাগাতে পেরেছে, সে বিষয়ে সাম্প্রতিককালে জোরদার অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। যে অনুসন্ধানের মধ্যে নিউইয়র্ক টাইমসও ছিল। সামরিক বাহিনীর উদ্যোগে চালিত এই আলো-আঁধারি অভিযানের অনেক খুঁটিনাটি তথ্য ফেসবুকও সত্য বলে মেনে নিয়েছে। এই কোম্পানির সাইবার নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান নাথানিয়েল গ্রেশার স্বীকার করেছেন যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে পরিষ্কার যোগাযোগ আছে, এমন প্রচার বার্তা কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়ার সুস্পষ্ট এবং পরিকল্পিত চেষ্টা যে হয়েছে তার প্রমাণ তারা পেয়েছেন। (জেনোসাইড ইনসাইড অন ফেসবুক, উইথ পোস্ট ফ্রম মিয়ানমার মিলিটারি। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, অক্টোবর ২০১৮।)

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুক গোটা বিশ্বেই পরিচিত। সাইবার জগতে এই মাধ্যমটি যেমন ভালো কাজের জন্য ব্যবহার হচ্ছে, তেমনই এটি অপরাধীদের অপরাধ সংগঠনের সূত্রপাতস্থলও বটে। এই মাধ্যমটি ব্যবহার করে যেমন অপরাধীরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে চলছে, তেমনি একই মাধ্যম ব্যবহার করে অপরাধ দমনে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধেরও অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। তাই তো মার্ক জুকারবার্গ স্বয়ং ফেসবুকের ‘ভ্রান্ত খবর’ বিষয়ে সতর্ক করে ব্যক্তিগত টাইমলাইনের সংবাদ বা প্রচারকে প্রাধান্য কম দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে সঙ্গত কারণেই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সামাজিক মাধ্যমের নির্ভরযোগ্যতা এবং বিশ্বস্ততা প্রশ্নবিদ্ধ কোনো কোনো ক্ষেত্রে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সংবাদ এবং তথ্যগুলোর কোনো দায় নেই। এর কোনো বিশ্বস্ত তথ্য উৎসও নেই, তাই তা মানুষের আস্থা অর্জনে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। এটি একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক, অন্যদিকে ব্যক্তিস্বার্থে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারেরও নজির রয়েছে। কখনও কখনও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন, নারীবিদ্বেষী মতবাদ প্রচারেও এটি ব্যবহৃত হয়। একই সঙ্গে কিছু গণমাধ্যমও নিউজ ভাইরাল করার নেশায় এমন সব কনটেন্টকে সামনে নিয়ে আসে যা মূলত নিউজ হওয়ার কোনো উপাদানই নয়। মূলধারার গণমাধ্যমগুলো প্রচার বাড়ানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার শরণাপন্ন হওয়াটাও এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অথচ মূলধারার সংবাদমাধ্যমের একটা নীতিমালা আছে। তাদের সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ আছে একজনের ব্যক্তিগত বিষয়ে কতটুকু যাওয়া যাবে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের সেই প্রশিক্ষণ সবার নেই, ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তির নাগরিক অধিকার খর্ব হয়। তবে কথা হলো ভাইরাল হওয়ার জন্য বা খবরের রিচ বাড়ানোর জন্য গণমাধ্যমও যদিও অপ্রশিক্ষিত ব্যবহারকারীদের মতো আচরণ করে সেটা খুবই দুঃখজনক। এই যে নানা ক্ষেত্রে ধর্ম, মতবাদ, নারীর প্রতি আচরণ অথবা প্রচলিত সংস্কৃতির বিপরীতে এক একটা ইস্যু তৈরি করে, সাইবার বুলিং বা ডিজিটাল আক্রমণ করা হয়, এটা আদতে সামাজিক বিভাজনের এক নোংরা রাজনীতি। যার অবাধ বিচরণ সোশ্যাল মিডিয়ায়। যা একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

সবশেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এসব সমস্যা দূর করতে হবে এর ব্যবহারকারীদেরই। ব্যবহারকারীদের দায়িত্বশীল হতে হবে। কেননা প্রকৃত খবর কোনটা বা প্রকৃত খবর কোনটা নয় সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। আগামী বছরের শুরুতে হতে চলেছে জাতীয় নির্বাচন। একে ঘিরে নানা প্রচার-প্রচারণা যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে প্রোপাগান্ডা, অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। এসব বিষয় মাথায় রেখে এই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সতর্কতা ও সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে। সবশেষে বলতে হয়, একটি অগণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে কোনোরকম হস্তক্ষেপ ছাড়া গণতন্ত্র চর্চার জন্য নাগরিকদের সচেতন আচরণ ও দায়িত্বশীলতার প্রয়োজন আছে বৈকি।


গাজী তানজিয়া : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক


মতামত লেখকের নিজস্ব