দ্রুত তদন্ত ও শাস্তি নিশ্চিত করুন
রাজধানীর অদূরে সাভারের আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাটি দুঃখজনক এবং উদ্বেগজনক। দুটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন ভয়াবহ সহিংসতাÑ যেখানে রাতভর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছেÑ তা শুধু শিক্ষার পরিবেশ নয়, সমাজের স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
ঘটনার শুরুটা ছিল একেবারে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। একজন শিক্ষার্থীর মোটরসাইকেল থেকে থুতু ফেলার সূত্র ধরে। অথচ সেই সামান্য বিষয়টি মুহূর্তের মধ্যেই রক্তাক্ত সংঘর্ষে পরিণত হলো। এ থেকে বোঝা যায়, শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রস্তুতি ও সহনশীলতার জায়গাটি কতটা দুর্বল।
বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞানচর্চা, গবেষণা ও মানবিক মূল্যবোধ গঠনের স্থান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সেখানে ক্রমেই অনুপ্রবেশ ঘটছে সহিংসতা, প্রতিহিংসা ও হিংস্র মনোভাবের। রাতভর সংঘর্ষে প্রশাসনিক ভবন, ব্যাংক বুথ, যানবাহনÑ কিছুই রক্ষা পায়নি। এমনকি শিক্ষক ও কর্মকর্তারাও ছিলেন নিরাপত্তাহীনতায়। এটি কেবল দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়; বরং উচ্চশিক্ষার নৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতার গভীর সংকেত।
ঘটনার পর দুই পক্ষই দায় চাপিয়েছে একে অন্যের ওপর। সিটি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য দাবি করেছেন, তাদের ক্যাম্পাসে হামলা চালিয়েছে ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা, যার ক্ষতি আনুমানিক ২০ কোটি টাকা। ড্যাফোডিলের এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক অভিযোগ করেছেন, তাদের শিক্ষার্থীদের ওপর প্রথমে হামলা চালায় সিটি ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা এবং পরে জিম্মি করে রাখে। উভয় পক্ষের বক্তব্যেই দায় এড়ানোর প্রবণতা স্পষ্ট। কিন্তু যে বাস্তব চিত্র সামনে এসেছেÑ তাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর বিভাজন ও সহিংস মানসিকতার প্রতিফলনই দেখা যায়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এই ঘটনার দায় এককভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। রাতে সহিংসতা শুরু হলেও যথাসময়ে কার্যকর হস্তক্ষেপ দেখা যায়নি। প্রক্টরিয়াল টিম বা নিরাপত্তাকর্মীদের উপস্থিতি কেবল আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল। পুলিশও সংঘর্ষের শুরুতে নিষ্ক্রিয় থেকেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অথচ সামান্য দৃঢ় প্রশাসনিক পদক্ষেপ বা সমন্বিত হস্তক্ষেপই হয়তো রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষ ঠেকাতে পারত।
এখন প্রশ্নÑ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন বারবার সহিংসতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে? এর উত্তর নিহিত রয়েছে তিনটি বড় সমস্যায়। প্রথমত, নৈতিক শিক্ষার অভাব। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহনশীলতা, যুক্তিবোধ ও মানবিকতা গড়ে তোলার যে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা থাকা উচিত, তা অনুপস্থিত। দ্বিতীয়ত, ক্যাম্পাসে প্রশাসনিক শৃঙ্খলার অভাব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত মনিটরিং, কাউন্সেলিং ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার কার্যকর ব্যবস্থা নেই। তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারÑ যা উত্তেজনা ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
এই ধরনের ঘটনা যখন ঘটে, তখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি হয় না; ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের ভাবমূর্তি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাধারণত আধুনিক শিক্ষা, পেশাদারত্ব ও শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু সিটি ও ড্যাফোডিলের এই সংঘর্ষ সেই ধারণাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এখন দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি। কে প্রথম আক্রমণ করেছে, কে উসকানি দিয়েছেÑ তা নির্ধারণে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। একই সঙ্গে উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বসে আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শান্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। জিম্মি, হামলা ও অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের আইনগতভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি স্থায়ী ‘ক্যাম্পাস শান্তি ও সংকট ব্যবস্থাপনা নীতি’ প্রণয়ন করা দরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শুধু ডিগ্রি অর্জনের জায়গা নয়, বরং মূল্যবোধ ও সহমর্মিতার বিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
এই ঘটনার মূল বার্তা একটাইÑ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু পাঠদান বা পরীক্ষার সংস্কার নয়, শিক্ষার্থীদের নৈতিক, সামাজিক ও নাগরিক শিক্ষা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনকে যদি আমরা সংঘর্ষের মাঠে পরিণত হতে দিই, তাহলে আগামী প্রজন্মের চিন্তা ও মানবিক গুণাবলিই ধ্বংস হবে। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষকদের সমন্বিতভাবে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবেÑ যাতে ভবিষ্যতে কোনো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর রক্ত, আগুন ও ধ্বংসযজ্ঞের ছবি না দেখতে হয়।