মেট্রোরেলের প্যাড মাথায় পড়ে মৃত্যু

জবাবদিহি নিশ্চিত করুন

সম্পাদকীয়
২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩৭
শেয়ার :
মেট্রোরেলের প্যাড মাথায় পড়ে মৃত্যু

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় গত রোববার মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু এবং দুজনের আহত হওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনক। এটি এমন এক অবকাঠামোগত ত্রুটি, যা প্রতিদিন হাজারো মানুষের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। প্রাণহানির ঘটনায় এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে- এই মেগা প্রকল্প কতটা নিরাপদ?

বিয়ারিং প্যাড হলো উড়ালসড়ক বা মেট্রোরেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত অংশ, যা মূলত পিলার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে স্থাপন করা হয়। এর কাজ হলো কাঠামোতে সৃষ্ট কম্পন শোষণ ও ভারসাম্য রক্ষা করা, যাতে সমগ্র ব্যবস্থাটি স্থিতিশীল থাকে। এত গুরুত্বপূর্ণ অংশ যদি খুলে পড়ে, তবে তা কেবল নির্মাণমানের নয়, প্রকল্প বাস্তবায়ন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং তদারকিরও চরম ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।

এ ধরনের দুর্ঘটনা যে প্রথম নয়, সেটিও আমাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেয়। গত বছর একই রুটের খামারবাড়ি এলাকায়ও একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। তখন বড় ধরনের প্রাণহানি না ঘটলেও পুরো রুটের ট্রেন চলাচল ১১ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। সে সময় তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু বছর না ঘুরতেই একই ঘটনা ঘটায় স্পষ্ট হয়- তদন্তের ফলাফল কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি কিংবা তা যথেষ্ট ছিল না।

অবকাঠামোগত ত্রুটি যে প্রযুক্তিগত ব্যর্থতার বাইরে বৃহত্তর প্রশাসনিক সমস্যার প্রতিফলন এবারও তা স্পষ্ট। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা, পরামর্শক, ঠিকাদার ও তদারক কর্তৃপক্ষ- সব পক্ষের দায়িত্ব এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে দিলেই চলবে না; এই মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি অবহেলার পরিণতি।

মেট্রোরেল প্রকল্পটি শুধু একটি পরিবহনব্যবস্থা নয়- এটি রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার প্রতীক। আন্তর্জাতিক সহায়তা, উন্নত প্রযুক্তি ও কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগের এই উদ্যোগে এমন ত্রুটি ক্ষমার অযোগ্য। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, দেশে বড় প্রকল্পগুলোর তদারকি ও মান নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় কতটা দুর্বলতা রয়ে গেছে। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ করার তাড়নায় প্রায়ই নির্মাণের গুণগত মান ও নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে। উদ্বোধনের পরও রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিদর্শনের কার্যক্রম প্রায়ই অবহেলিত হয়, ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি বাড়ে।

সরকার যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, তা অবশ্যই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। তবে তদন্তেই সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো লাভ হবে না। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, দেশে বহু তদন্ত হয়, রিপোর্ট জমা পড়ে, কিন্তু বাস্তবায়ন বিরল। এবার যদি আবার সেই পুরনো চিত্রই দেখা যায়, তবে তা হবে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গ।

এ অবস্থায় সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন, তা হলো নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে দায় নির্ধারণ এবং দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। একই সঙ্গে এখনই মেট্রোরেলের প্রতিটি পিলার, সংযোগ ও যান্ত্রিক অংশের পূর্ণাঙ্গ পরিদর্শন জরুরি। কেবল প্রকল্প কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ তদারকির ওপর নির্ভর না করে, একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দলের মাধ্যমে নিরাপত্তা মূল্যায়ন করা উচিত।

নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, ত্রৈমাসিক পরিদর্শন এবং প্রযুক্তিগত ত্রুটি শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। যে কোনো মেগা প্রকল্পে ঝুঁকি শূন্য করা না গেলেও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাই উন্নয়নের মানদণ্ড- এটি এখনই বুঝে নেওয়া দরকার।

এ ঘটনায় একটি বড় শিক্ষা লুকিয়ে আছে- উন্নয়ন কেবল দৃশ্যমান স্থাপনা নয়; এর মূল সাফল্য নিরাপত্তা, স্থায়িত্ব ও জনগণের আস্থায় নিহিত।

বলার অপেক্ষা রাখে না, ঢাকার মেট্রোরেল নিঃসন্দেহে আমাদের গর্বের প্রকল্প- এটি নগর পরিবহনে নতুন দিগন্ত খুলেছে। কিন্তু এই গর্ব তখনই অর্থবহ হবে, যখন জনগণ নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে- এই রেলপথ তাদের জন্য নিরাপদ। এখনই সময় দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার, তদারকি কাঠামো শক্তিশালী করার এবং অবহেলার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার।