মামদানিকে আক্রমণের নেপথ্যে বর্ণবাদ ও ইসলামবিদ্বেষ

রিচার্ড লাসকম্ব
২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩৬
শেয়ার :
মামদানিকে আক্রমণের নেপথ্যে বর্ণবাদ ও ইসলামবিদ্বেষ

বৃহস্পতিবার সকালে নিউইয়র্কের মেয়র পদের শেষ নির্বাচনী বিতর্কে নিজের পক্ষে ফল টানতে ব্যর্থ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর, অ্যানড্রু কুওমো তার প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটদলীয় জোহরান মামদানির ওপর আবার যে আক্রমণ শুরু করেন, তা ছিল পরিচিত সেই বর্ণবাদিতায় ভরপুর।

‘খোদা না করুন, আরেকটি ৯/১১, মামদানিকে আপনি মেয়রের আসনে কল্পনা করতে পারেন?’ স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক গভর্নর এ কথা বলেন রক্ষণশীল রেডিও টক শোর উপস্থাপক সিড রোজেনবার্গকে; ২০০১ সালে ইসলামি চরমপন্থিদের নিউইয়র্কে সন্ত্রাসবাদী হামলার উল্লেখ করে।

‘উনি তো উল্লসিত হবেন’, জবাব দেন রোজেনবার্গ, কুওমোকে উৎসাহ জোগাতে, যিনি এর আগে মামদানিকে ‘সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, কুওমো হাসতে হাসতে ঘোষণা করেন, ‘এটা আরেকটা সমস্যা।’

আগামী মাসের নির্বাচনে জয়ী হলে মামদানি হবেন এই নগরীর প্রথম মুসলিম মেয়র, তিনি নিউইয়র্কের পিক্স১১ নিউজের এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ওই মন্তব্যের নিন্দা করেছেন ‘জঘন্য’ ও ‘বর্ণবাদী’ হিসেবে। ‘জনতার সামনে এটা অ্যানড্রু কুওমোর জীবনের শেষ মুহূর্ত এবং এই মুহূর্তগুলো তিনি খরচ করছেন বর্ণবাদী আক্রমণ করে’, তিনি বলেন।

মামদানির কথা যদি ক্লান্তিকর মনে হয় তবে সেটা কুওমোর প্রকাশ্যে অপমানমূলক কথাবার্তা বলার কারণে; গত জুনে প্রাথমিক পর্বে ডেমোক্র্যাটিকদের কাছে গুঁড়িয়ে যাওয়ার পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন কুওমো। তারপর বিভিন্ন দিক থেকে মামদানির ওপর ব্যক্তিগত অপমান আর ধর্মান্ধতার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন ধারাবাহিকভাবে; এবারের ঘটনা তারই সর্বশেষ নজির। এমনকি বৃহস্পতিবারই পরের দিকে নিউইয়র্ক সিটির বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস ‘কমিউনিস্ট’ বলে আখ্যায়িত করেন মামদানিকে এবং বলেন তিনি কুওমোর পৃষ্ঠপোষকতা করছেন ইসলামি চরমপন্থা ও সেই লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যারা আগুনে ‘গির্জা পোড়াচ্ছিল।’

মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই মামদানি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন তার প্রতিপক্ষ ও নানা রাজনীতিকের, ধনী দাতা ও অন্যদের, ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত। ‘নিউইয়র্কের মেয়র একজন কমিউনিস্ট’ এ সম্ভাবনায় বিলাপ করেছেন তিনি এবং অঙ্গীকার করেছেন এই লোককে ঠেকাতে হোয়াইট হাউসের ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। ট্রাম্পের অনুগত এলিস স্টেফানিক, নিউইয়র্কের রিপাবলিকান দলীয় কংগ্রেস সদস্য এবং স্টেট গভর্নরের মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন বলে জানা গেছে; তিনি মামদানিকে ‘মেয়র পদে একজন জিহাদি প্রার্থী’ হিসেবে বর্ণনা করে তার নিন্দা করেছেন এক টুইটে।

ইতোমধ্যে নিউইয়র্কের কয়েকশ রাব্বি উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন মামদানি ইসরায়েলের সমালোচনা করায় এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দেওয়ায়। তারা এ সপ্তাহে স্বাক্ষরিত এক খোলা চিঠিতে কোলাহল করে বলেছেন যে, ‘ইহুদিদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার’ জন্য মামদানি এক হুমকি।

জুন মাসে মামদানি ‘ভয়ঙ্কর ইসলামবিদ্বেষের’ জন্য সমালোচনা করেছিলেন কুওমোর পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটির (পিএসি)। তার বিরুদ্ধে ওই কমিটি ইহুদিবিরোধিতার অভিযোগ আনার পর এবং ডেমোক্র্যাটের মুখ হিসেবে তুলে ধরে ঘন-কালো-দীর্ঘ দাড়ি লাগিয়ে তার ছবি বিকৃত করে প্রচারের পর। বুধবার রাতে বিতর্ক চলার সময় কুওমোর টিম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বানানো একটা বর্ণবাদী বিজ্ঞাপন পোস্ট করেছিল এক্সে, সেটার শিরোনাম ছিল ‘জোহরান মামদানির পক্ষে অপরাধীরা’ এবং দ্রুত সরিয়েও ফেলেছিল। সেই বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছিল- জনপ্রিয় ডেমোক্র্যাটিক সোস্যালিস্ট স্টেটের অ্যাসেম্বলিম্যানরা তার হাত থেকে ভাত খাচ্ছে, তার আগে তাদের মদদ দিচ্ছে কেফিয়েহ্ পরা একটা কালো লোক যে দোকানের জিনিস চুরি করছে, এক নারীকে পীড়ন করছে, সে একজন সেক্স ট্র্যাফিকার এবং মাদক কারবারি। নিউইয়র্কের নির্বাচনী দৌড়ের পর্যবেক্ষকরা বলেন, প্রচারণায় এমন মাত্রার তীব্র ব্যক্তিগত বিদ্রƒপ আগে আর দেখেননি তারা। মামদানিকে তারা ক্রেডিট দিয়েছেন রাজনৈতিক পরিপক্বতার জন্য। ‘যেভাবে তিনি ওই আক্রমণ সামলেছেন তা সত্যিই হৃদয়গ্রাহী’, বলেন নিউইয়র্ক’স পেস ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর লরা ট্যামান। ‘ব্র্যাড ল্যান্ডার (নিউইয়র্ক সিটির কম্পট্রলার ও একজন ডেমোক্র্যাট) যদি মনোনয়ন পেতেন, তাহলে একই পথের পথিক হলেও মামদানির মতো আক্রমণের শিকার হতেন না তিনি। কাজেই জলের মতো পরিষ্কার যে, মুসলিমবিরোধী আর পক্ষপাতদুষ্ট বর্ণবাদী মনোভাব রয়েছে এখানে। এমন পরিস্থিতিতে মামদানি নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখেছেন হাসি মুখে যা সত্যিই মনে দাগ কাটে।’

কুওমো এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া যেসব বিষয়ে আক্রমণ করেছেন ওই বিতর্ককালে, সেগুলোর একটি হলো ৮৫ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি নগরী পরিচালনার প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই মামদানির। ট্যামান জবাবে বলেছেন, ‘তৃণমূলের ব্যাপক সমর্থন পেয়ে তিনি ডেমোক্র্যাটিক দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার অভাব তার জন্য কাজের হবে, কেননা তিনি মুষ্টিমেয় একদল লোকের পক্ষে কাজ করার রাজনৈতিক ধারার বাইরে থাকতে পারবেন। যার অর্থ তিনি নিজের মূল্যবোধের প্রতি অবিচল থাকবেন আর আত্মবিশ্বাস অনুভব করবেন তার কথায়।’

ট্যামান বলেন, কুওমোর ওইসব আক্রমণ বুমেরাং হবে এবং কুওমো সময়কে পড়তে পারছেন না।

মামদানি বৃহস্পতিবার টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘নিউইয়র্কের সব মুসলিম সমতা আর মর্যাদার বিষয়টি উপলব্ধি করতে চান যা প্রত্যেক নিউইয়র্কবাসীর প্রাপ্য; সেটাও উপেক্ষা করছেন সাবেক গভর্নর।’

রাজনৈতিক আক্রমণের সমান্তরালে চলছে তার বিরুদ্ধে কুওমোর সমর্থক ও ধনী দাতাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, তার বিরুদ্ধে নিজেদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করছে। বিল অ্যাকম্যান আগে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন করলেও ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মদদ দেন ট্রাম্পকে। তিনি হেজ ফান্ডের ব্যবস্থাপক। এ মাসেই ১০ লাখ ডলার দান করেছেন ডিফেন্ড এনওয়াইসি প্যাক নামক গ্রুপকে এবং কুওমোপন্থি আরেকটি গ্রুপকে গত জুনে দিয়েছেন ৫ লাখ ডলার। এ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যম পলিটিকো।

মামদানির বিপক্ষে অন্যান্য নামজাদা বিলিয়নেয়ারদের মধ্যে রয়েছেন নিউইয়র্ক সিটির সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ; ব্যবসায়ী রোনাল্ড লডার, যিনি ওয়ার্ল্ড জিউইশ কংগ্রেসের সভাপতি; আছেন হেস করপোরেশনের জন বি হেস। ওয়াশিংটন হাইটসে ১৩ অক্টোবর এক র‌্যালিতে মামদানি এই ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপের বিষয়টি প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন বিষয়টিকে তিনি প্রশংসা হিসেবে দেখছেন।

‘বিল অ্যাকম্যান আর রোনাল্ড লডারের মতো বিলিয়নেয়াররা এই দৌড়ে কোটি কোটি ডলার ঢেলেছেন, কারণ তারা বলেন আমরা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছি। আমি এখানে এসেছি স্বীকার করতে- তারা ঠিকই বলেছেন’, বলেন জোহরান মামদানি।

রিচার্ড লাসকম্ব : দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদক

দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত (২৫.১০.২০২৫) নিবন্ধ, অনুবাদ : আমাদের সময় ডেস্ক

মতামত লেখকের নিজস্ব