শৈশব হোক আনন্দের

সাকিবুল ইসলাম
২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫০
শেয়ার :
শৈশব হোক আনন্দের

একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সেই জাতির শিশুদের ওপর। শিশুরা আজকের নয়- তারা আগামী দিনের নাগরিক, সমাজের চালিকাশক্তি। তাই শিশুদের সঠিক পরিচর্যা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করা। কিন্তু বাস্তব চিত্রে আমরা দেখি- শিশুশ্রম, অপুষ্টি, নির্যাতন, শিক্ষাবঞ্চনা ও শৈশবহীন জীবনের যন্ত্রণা এখনও সমাজে বিদ্যমান।

আমরা প্রায়ই লক্ষ করি, অনেক শিশু বিদ্যালয়ে না গিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। একটি শিশু যখন ভোরবেলা স্কুলের বদলে ইটভাটার পথে হাঁটে, তখন তার হাতে জাতির ভবিষ্যৎও মলিন হয়ে যায়। শৈশব তো খেলাধুলা, হাসি আর গল্পের সময়, কিন্তু আমাদের দেশে অনেক শিশুর কাছে সেটি বিলাসিতা। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় হলো শৈশব। এই সময়েই গড়ে ওঠে একটি শিশুর মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক বিকাশের ভিত। কিন্তু দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য ও অজ্ঞতার কারণে অনেক শিশু সেই স্বাভাবিক বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের হাতে বইয়ের পরিবর্তে তুলে দেওয়া হয় হাতুড়ি, ইট, বালতি কিংবা গৃহস্থালির কাজ। বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য তৈরির কারখানায়, লেদ ও ওয়েল্ডিং মেশিনেও তারা কাজ করছে। গাড়ি বা টেম্পোর সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করছে। বর্জ্য ঘেঁটে তা থেকে প্রয়োজনীয় বিক্রিযোগ্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করছে। কিন্তু কেন শিশুরা এসব কাজ করছে?

ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। অতিরিক্ত শ্রমের কারণে নানা ধরনের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। একই বয়সী শিশুদের বিদ্যালয়ে যেতে দেখে, খেলতে দেখে এবং মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে যেতে দেখে শিশু শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারাও এসব পেতে চায়। তাই চাহিদার অপূর্ণতা থেকে শিশু মনে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয়। শিশু স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। সমাজ ও সমাজের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। শিশু-মনে এক প্রকার হিংস্রতা ও ক্ষিপ্রতার জন্ম নেয়। এসব শিশু আবেগহীন, ভয়হীন হয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। অপুষ্টি, অনিদ্রা, বিশ্রামহীন জীবন শিশু শ্রমিকের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।

অনেক সময় এসব শিশু যথাযথ পারিশ্রমিক, খাবার ও স্বাস্থ্যসেবা পায় না। স্নেহ, মায়া, মমতা কী তারা তা জানে না। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন তাদের নিত্যসঙ্গী। অথচ তাদেরও আছে বিকশিত হওয়ার অধিকার। কায়িক পরিশ্রমের ফলে তাদের ঘুম কমে যায়, শরীর শুকিয়ে যায়, মন নিস্তেজ হয়। একটি নীরব, ভয়হীন, আবেগহীন বাস্তবতার মধ্যে তারা বড় হতে থাকে, যেখানে হাসিটাও যেন শেখা বিষয়। যে বয়সে তারা মাঠে ছুটে বেড়ানোর কথা, সে বয়সে তারা টাকার জন্য সময় বিক্রি করে। এই অবস্থা শুধু দারিদ্র্যের দায় নয়, এটি আমাদের উদাসীনতার ফল। আমরা অনেকেই শিশুশ্রম দেখেও চুপ থাকি। মনে করি, ‘বেচারা কাজ না করলে খাবে কী?’ কিন্তু আমাদের এই নীরবতাই আসলে শোষণকে বৈধতা দেয়। এখন সময় এসেছে দায়িত্ব নেওয়ার। এ ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র- সবার ভূমিকা আছে। শিক্ষা, পুষ্টি আর নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে শিশুশ্রম থামবে না। আর আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেদের কাজের জায়গা বা আশপাশে যদি কোনো শিশুশ্রম দেখি সেটা স্বাভাবিক না ধরে প্রতিবাদ করা। একটি শিশুর হাসি শুধু তার নয়, একটি জাতির আশার প্রতীক। সেই হাসিটিই ফিরিয়ে দিতে পারলে আমরা মানবিক সমাজের পথে এগোব কাগজে-কলমে নয়, বাস্তব জীবনে। ভালো পরিবেশে শিশুরা বেড়ে উঠলে পরিবার ও সমাজের প্রতি তারা দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে। এসব শিশুর প্রতি ভালো আচরণের মাধ্যমে আমরা নিজেরাও মানবিক গুণসম্পন্ন নাগরিক হয়ে উঠতে পারব।

শিশুদের শৈশব যেন আনন্দে, খেলাধুলায় ও শিক্ষায় ভরে ওঠে- এটি শুধু একটি মানবিক দাবি নয়, এটি জাতীয় অগ্রগতির শর্ত। তাই এখনই আমাদের প্রতিজ্ঞা করা উচিত- কোনো শিশু যেন অবহেলিত না থাকে, কোনো শিশুর হাসি যেন কেড়ে না নেওয়া হয়।


মো. সাকিবুল ইসলাম : শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ,

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা