পতনের নেপথ্যে মতপ্রকাশের অধিকার হরণ
দেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। অনেকের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পেছনে একটা মেটিক্যুলাস ডিজাইনের আন্দোলন ছিল। মূলত শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতি দীর্ঘকালের ক্ষোভের ফলে পথে নেমেছিল সাধারণ মানুষ। অধিকাংশ মানুষই নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছে। কথায় বলে, করো অথবা মরো, নিশ্চিত মৃত্যু হতে পারে জেনে, নিজের পাশে লাশ দেখেও মানুষ এগিয়ে গেছে। অর্থাৎ জীবনের চেয়েও এই জাঁতাকল থেকে মুক্তি পাওয়ার তাড়নায় মানুষ লড়তে বাধ্য হয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে, শেখ হাসিনা আসলে এমন অত্যাচারী কেন হয়ে উঠল যে- পুরো মন্ত্রিসভা, সংসদ, এমনকি জাতীয় মসজিদের খতিবকে পর্যন্ত পালিয়ে যেতে হলো। ভবিষ্যতে যারা দেশ চালানোর স্বপ্ন দেখছে তাদের প্রত্যেকেরই উচিত শেখ হাসিনার পতনের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণ খুঁজে বের করা। কারণ যে তরুণ প্রজন্ম লড়তে শিখে গেছে, মৃত্যুকে বরণ করতে শিখে গেছে, তাদের আর কিছু দিয়েই আটকানো যাবে না। তাদের মায়ায় বাঁধতে হবে, তার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে কাজ করতে হবে এবং তাদের কথা বলতে দিতে হবে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের আক্রোশ তৈরি হওয়ার পেছনে বিশাল একটা জায়গাজুড়ে ছিল মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করা। এই মত শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করতে না পারার ব্যাপার নয়। বরং সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, মানুষ পাঁচ বছর পরপর যে রাজ্য গড়ার ক্ষমতা হাতে পায় সেই ক্ষমতাকে হরণ করা হয়েছিল।
তাকে বারবার ক্ষমতায় আসতে মানুষের ভোটের প্রয়োজন পড়েনি। পাঁচ বছর পর যে জনগণের কাছে আবার ভোট চাইতে যেতে হবে, সেই চিন্তা তার ছিল না। এই চিন্তু যখন কারও মাথায় থাকবে না তখন তার আর মানুষের অধিকার নিয়ে ভাবার প্রশ্ন ওঠে না। তখন তিনি ভাবতে থাকেন শুধু নিজের সুবিধা। ঠিক সেই কাজটাই করেছেন তিনি। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিরোধী মতকে দমন করার অভূতপূর্ব উদাহরণ দেখিয়েছেন।
এই পথে আগানোর জন্য শেখ হাসিনা প্রথমেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে নিয়েছেন। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এরপর আমরা দেখেছি দেশের ইতিহাসের তিনটি কলঙ্কজনক অগণতান্ত্রিক নির্বাচন। প্রথমে ২০১৪ সালে সব দল-মতের তোয়াক্কা না করে একপেশে একটা নির্বাচন আয়োজন করা হয়, যেখানে ১৫৩ জন সাংসদ ভোটগ্রহণের আগেই নির্বাচিত হয়ে যায়। ভোটারের উপস্থিতির চিত্র শুধু বাংলাদেশ নয়, অবাক করে দেয় পুরো বিশ্বকেই। এরপর ২০১৮ সালে ভোটগ্রহণের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স আওয়ামী লীগের মার্কা ‘নৌকায়’ সিল মেরে ভরে রাখা হয় সারাদেশে, যে কাজে সরকারি প্রশাসন অংশ নেয় আওয়ামী লীগের বাহিনীর সঙ্গে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তো অনেক দূরের কথা, অন্য দলের প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর চালানো হয় সীমাহীন নির্যাতন, হামলা, মামলা, গ্রেপ্তারসহ নানাকিছু। এরপর ২০২৪ সালে আমরা দেখলাম একটা পাতানো নির্বাচন, কে কোথায় এমপি নির্বাচিত হবে তা ঠিক করেছে শেখ হাসিনা নিজেই।
জনরায়কে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা টিকে ছিলেন রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। এই যে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম শাসক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তার মূলে ছিল নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা।
এবারের নির্বাচনে প্রায় অর্ধকোটির মতো নতুন ভোটার আসবে। বিশেষ করে যাদের বয়স ত্রিশের কোটা পার হয়ে গেছে কিন্তু ভোট দিতে পারেননি সেই ধরনের ভোটারও আছে। মানুষের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার বিপরীতে গিয়ে যত শক্তিধরই হোক, টেকা যে সম্ভব নয় তা প্রমাণ হয়েছে শেখ হাসিনার পতনে। আগামী দিনে যারাই রাষ্ট্রের দায়িত্বে আসতে চায় তাদের অবকাঠামো, প্রশাসনিক সংস্কার, অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নতির পাশাপাশি মানুষের মতপ্রকাশের অধিকারকে গুরুত্ব দিতেই হবে। মানুষকে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার ক্ষমতাটা বুঝিয়ে দেওয়া গণতন্ত্রের জন্য জরুরি।
মাহবুব নাহিদ : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?
মতামত লেখকের নিজস্ব