কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা উপেক্ষিত থাকবে?

ফেরদৌস আরা রুমী
২৪ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৪০
শেয়ার :
কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা উপেক্ষিত থাকবে?

কর্মক্ষেত্রে যৌন শোষণ, নির্যাতন, হয়রানি কোনো নতুন সমস্যা নয়; এটি সমাজের গভীরে প্রোথিত এক অমানবিক আচরণ এবং ফৌজদারি অপরাধ। পৃথিবীর প্রায় সব সমাজেই এর অস্তিত্ব রয়েছে এবং পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় এটি ব্যাপকতা পায়। নারীর ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মানসিকতা থেকেই এই অন্যায় আচরণের জন্ম হয়। আইন, নীতিমালা ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও যৌন শোষণ ও হয়রানি এখনও বন্ধ হয়নি, কারণ ক্ষমতার পার্থক্য, প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা, নিপীড়কের সামাজিক মর্যাদা, নারীর মর্যাদাবোধকে গুরুত্বহীন করে দেখা, বিচারহীনতা ইত্যাদি যা নিপীড়কের পক্ষে কাজ করে যায়। বর্তমান বাস্তবতায় সরকারি-বেসরকারি কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম- সব জায়গাতেই নারীরা কাজ করলেও তার জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ গড়ে তোলায় কেউ আন্তরিক হয়নি। সে জন্য বহুসংখ্যক নারী একসঙ্গে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলেও নানা বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শারীরিক, মানসিক ও মৌখিকভাবে চলমান এই নিপীড়ন শুধু ভুক্তভোগী ব্যক্তির মর্যাদা নষ্ট করে না, তার কর্মপরিবেশকেও প্রতিকূল করে তোলে। যৌন শোষণ, নির্যাতন, হয়রানি মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। নারীর সকল ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ও উন্নয়নের অন্যতম বড় বাধা।

যৌন শোষণ, হয়রানি ও নিপীড়ন কেবল ব্যক্তিগত অনৈতিকতা নয়, এটি পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় টিকে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা। সম্প্রতি বাংলা স্ট্রিমের বাংলা বিভাগের প্রধানের বিরুদ্ধে মৌখিক যৌন হয়রানির অভিযোগ এবং পরবর্তী সময়ে এক নারী কর্মীর আত্মহত্যায় ঘটনায় বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে- কর্মক্ষেত্রগুলো কতটা নিরাপদ? যথেষ্ট পরিমাণ আইনি কাঠামো থাকা সত্ত্বেও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ন্যায়বিচার এখনও কাগুজে। সমাজে এ বিষয়ে আইনের প্রয়োগ এবং জোরালো অবস্থান; নিদেনপক্ষে সচেতনতাবোধের অভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাশালী নিপীড়কের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং ভিকটিম বিচার না পেয়ে দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যায়, কখনও নিজেকে মেরেও ফেলে।

এ সংক্রান্ত আইনি সুরক্ষায় দেখা যায়- মহামান্য উচ্চ আদালত ২০০৯ সালে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি নির্দশনা দেন, যা সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে অবশ্যপালনীয় এবং এ সংক্রান্ত আইন না হওয়া পর্যন্ত ওই নির্দেশনা আইন হিসেবে গণ্য হবে। শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালার (২০২২ সালে সংশোধিত) ৩৬১(ক) ধারায় প্রতিটি নারীর নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। একইভাবে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন অধ্যাদেশ (২০২৫ সালে সংশোধিত) এবং দণ্ডবিধির ৩৫৪ ও ৫০৯ ধারায় যৌন হয়রানিমূলক আচরণকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে।

বহু নারী কর্মীর জন্য তার কর্মস্থানটি বিভীষিকাময়, কারণ এখানে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি নীরবে চলতে থাকে। যখন প্রকট রূপ নেয় তখন তা যৌন নির্যাতন বা সহিংসতায় পর্যবসিত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় কর্মীরা যৌন সম্পর্কিত আপত্তিকর আচরণ সম্পর্কে ধারণা ও পার্থক্য বুঝতে পারেন না। কিন্তু প্রতিষ্ঠান/ম্যানেজমেন্টকে কর্মীদের মধ্যে সেসব আচরণবিধি এবং কী করা যাবে, কী করা যাবে- এ সম্পর্কিত ধারণা শুরুতে প্রদান করা বাঞ্ছনীয়। অপরাধের মাত্রা বুঝে সে অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে প্রতিষ্ঠান। সে জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে সবার আগে দরকার একটি পূর্ণাঙ্গ যৌন নির্যাতন ও হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন।

সাধারণত যৌন শোষণ, নির্যাতন ও হয়রানি একই অর্থে ব্যবহার করলেও এগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যৌন শোষণ হলো ক্ষমতার পার্থক্য কিংবা বিশ্বাসের জায়গাকে পুঁজি করে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যৌন স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা; যেমন- একজন বস/সুপারভাইজার যদি পদোন্নতি বা চাকরির বিনিময়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেন। অন্যদিকে, যৌন নির্যাতন বা সহিংসতা হলো প্রত্যক্ষভাবে বা ভয়ভীতি দেখিয়ে যৌন লালসার জন্য শারীরিকভাবে (অসম বা বলপূর্বক বা জোর করে) স্পর্শ বা ধর্ষণ করা। আর যৌন হয়রানি হলো অনাকাক্সিক্ষত যৌন আবেদনমূলক আচরণ, যৌন অপরাধমূলক মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি বা শারীরিক স্পর্শ, যা একজন ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে বা ভীতিকর, প্রতিকূল কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করে। এ ধরনের আচরণ পুরুষ এবং নারী উভয়ের বিরুদ্ধেই ঘটতে পারে, তবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামো ও ক্ষমতা সম্পর্কের কারণে নারীরাই এর প্রধান শিকার।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষের ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই কর্মক্ষেত্রের ক্ষমতার কাঠামো গঠিত হয়। সেখানে নারীকে দেখা হয় ‘সহায়ক’ বা ‘নিম্নতর’ কর্মী হিসেবে। ফলস্বরূপ, ক্ষমতাবান পুরুষরা অনেক সময় নারী সহকর্মীর দুর্বলতা, নির্ভরশীলতা বা সামাজিক অবস্থানকে ব্যবহার করে যৌন উদ্দেশ্যে প্রভাব বিস্তার করে। এই প্রভাব হতে পারে কথার মাধ্যমে, ইঙ্গিতে, কাজের সুযোগ বা পদোন্নতির বিনিময়ে, কিংবা পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করে। এটিই মূলত যৌন শোষণের রূপ। কর্মক্ষেত্রে যৌন শোষণের রূপটি মূলত বেশি দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে এই শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তুললেই শুরু হয় ‘ভিকটিম ব্লেমিং’। অভিযোগকারীকেই দোষারোপ করা হয়, বলা হয় সে হয়তো অতিরিক্ত সংবেদনশীল, কিংবা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে অভিযোগ করেছে। অনেক সময় প্রতিষ্ঠানও চুপ থাকে, যদি অভিযুক্ত ব্যক্তিটি প্রভাবশালী হয়। কারণ তার সোশ্যাল ক্যাপিটাল আছে- সমাজে পরিচিত, সম্মানিত, মর্যাদাশীল গুরুত্বপূর্ণ মুখ। ফলে প্রতিষ্ঠান ভিকটিমকে আড়াল করে দেয়, যেন তার অভিযোগ প্রকাশ না পায়, প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষা পায়। নিপীড়ক আরও সাহস পায়, অন্যদিকে ভিকটিম একা হয়ে পড়ে। ভুক্তভোগী ব্যক্তিটি দীর্ঘ মেয়াদে ভয়, হতাশা, দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা, অমনোযোগ, স্বাভাবিক কাজ করতে না পারা, কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে না পারা, খিটখিটে মেজাজ, ঘুমাতে না পারা, নিজেকে গুটিয়ে ফেলা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, নিজেকে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা সব হারিয়ে ফেলেন।

বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে যৌন শোষণ/নির্যাতন/হয়রানি প্রতিরোধে শুধু আইন নয়, প্রয়োজন মানসিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন। প্রথমত, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে লিখিত যৌন শোষণ, নির্যাতন ও হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা থাকবে- কী ধরনের আচরণ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়া কী, তদন্তের ধাপ কীভাবে চলবে এবং কী ধরনের শাস্তি প্রযোজ্য। দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রতিবছর যৌন বিষয়ে প্রশিক্ষণ বা ওরিয়েন্টেশন দিতে হবে- যেন সবাই জানে, এ বিষয়ে শূন্য সহনশীলতা নীতি (zero tolerance) কার্যকর। তৃতীয়ত, প্রতিটি অভিযোগের তদন্ত নিরপেক্ষ করতে হলে কমিটিতে বাইরের (external) সদস্য এবং নারী সদস্য (অন্তত দুজন) রাখা জরুরি। এতে অভ্যন্তরীণ প্রভাব কমে।

একই সঙ্গে ভিকটিমের মানসিক সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ। যৌন হয়রানির শিকার নারীরা প্রায়ই লজ্জা, ভয় বা সামাজিক চাপের কারণে চুপ করে থাকেন। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত তাদের জন্য মানসিক কাউন্সেলিংয়ের সুযোগ রাখা, যেন তারা নির্ভয়ে কথা বলতে পারেন। তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখলে ভিকটিমের নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। অভিযোগ মীমাংসা হলেও তা লিখিতভাবে রেকর্ড রাখতে হবে এবং উভয় পক্ষের স্বাক্ষরসহ রিপোর্ট সংরক্ষণ করতে হবে।

নারীরা প্রতিটি পেশায় নিজেদের জায়গা তৈরি করছেন। তাদের প্রতিভা, পরিশ্রম ও নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতি এগোচ্ছে। কিন্তু যদি সেই কর্মক্ষেত্রই নিরাপদ না হয়, তাহলে এই অগ্রগতি থেমে যাবে। যখন নারী নির্ভয়ে এবং সমান মর্যাদার সঙ্গে কাজ করতে পারবে, তখনই কেবল জাতি হিসেবে আমাদের সত্যিকারের অগ্রগতি নিশ্চিত হবে।

ফেরদৌস আরা রুমী : লেখক ও অধিকারকর্মী

মতামত লেখকের নিজস্ব