সম্ভাবনার খনি, সংকটে দিশাহারা

ফারিহা জামান নাবিলা
২৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০৮
শেয়ার :
সম্ভাবনার খনি, সংকটে দিশাহারা

চামড়াশিল্প আমাদের দেশের এক লুকানো রত্নের মতো। বাংলাদেশের চামড়াশিল্পে রয়েছে অপরিসীম সম্ভাবনা কিন্তু যত্ন আর সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে সেই সম্ভাবনা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ঈদের পর গ্রামগঞ্জ থেকে শহর পর্যন্ত যত কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয় তা যেন এক বিশাল সম্পদের পাহাড়। কিন্তু আমরা নিজেরাই সেই সম্পদ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি না। ফলে বিদেশিরা আমাদের কাঁচা চামড়া নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে বহুগুণ দামে বিক্রি করে। আমাদের চামড়াশিল্পে দক্ষ ব্যবস্থাপনা, আধুনিক প্রযুক্তি আর পরিকল্পনার ছোঁয়া ছাড়া তার আসল রূপ পায় না। এখন সময় এসেছে সেই হারানো উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনার যেন এই শিল্প আবার বাংলাদেশের অর্থনীতির এক উজ্জ্বল প্রতীকে পরিণত হয়।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ চামড়া উৎপাদনকারী দেশ। ঈদুল আজহার পর প্রতিবছর কোটি টাকার বেশি মূল্যের কাঁচা চামড়া পাওয়া যায়। দেশে শতাধিক ট্যানারি, অসংখ্য জুতা, ব্যাগ ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরকার এই শিল্পকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সম্ভাবনার পরও বাস্তবে এই খাত নানা সংকটে ভুগছে। বর্তমানে প্রায় দুই লাখ মানুষ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। অথচ বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অংশীদারত্ব কমছে, কারণ আমরা মান নিয়ন্ত্রণ, প্রযুক্তি, ব্র্যান্ডিং ও বাজার সম্প্রসারণে পিছিয়ে আছি। তবু আশার কথা হলো- চামড়াশিল্প এখনও এমন একটি খাত, যা সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির ব্যবহারে আবারও দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হতে পারে।

বাংলাদেশের আবহাওয়া, পশুপালন ব্যবস্থা এবং দক্ষ শ্রমশক্তি এই শিল্পের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। প্রতিবছর কোরবানির ঈদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়, যা জাতীয় উৎপাদনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের সমান। সেই কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত হয়ে তৈরি হয় জুতা, ব্যাগ, বেল্ট, পার্স, ওয়ালেটসহ নানারকম চামড়াজাত পণ্য, যেগুলোর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে।

বাংলাদেশের চামড়াশিল্পে সংকটের মূল কারণগুলো বহুমাত্রিক। একদিকে রয়েছে অব্যবস্থাপনা ও নীতিগত দুর্বলতা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা, মান নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশগত সমস্যাও বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশগত সমস্যা বিদেশি ক্রেতাদের চোখে বাংলাদেশের চামড়াশিল্পকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতিবছর ঈদুল আজহার সময় যে বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া পাওয়া যায়, তা সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত না হওয়ায় অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। ঠাণ্ডা সংরক্ষণাগার এবং সংরক্ষণ প্রযুক্তির অভাব, সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে খামারিরা ন্যায্য দাম পান না। বাংলাদেশের বেশির ভাগ ট্যানারি ও চামড়া পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এখনও পুরনো যন্ত্রপাতি ও প্রক্রিয়া ব্যবহার করছে। আধুনিক প্রযুক্তি, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, এবং গবেষণার ঘাটতির কারণে উৎপাদনের মান ও দক্ষতা উভয়ই কমে গেছে। বিশ্ববাজারে পণ্য রপ্তানির জন্য আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা জরুরি। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান এসব মান পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে ইউরোপ ও আমেরিকার বড় ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছেন। অনেক উদ্যোক্তা পর্যাপ্ত মূলধন ও ঋণ সুবিধা না পাওয়ায় নতুন প্রযুক্তি কেনা বা উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না। ব্যাংকগুলো চামড়া খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে, কারণ এই খাতে অনিশ্চয়তা বেশি। বাংলাদেশ এখনও আন্তর্জাতিকভাবে শক্তিশালী ব্র্যান্ড গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে আমাদের পণ্য বিদেশে অন্য দেশের ব্র্যান্ড নামে বিক্রি হয়। এর ফলে আমরা পণ্যের প্রকৃত মূল্য ও স্বীকৃতি দুটোই হারাচ্ছি। এই শিল্পে অনেক শ্রমিক কাজ করলেও তাদের মধ্যে আধুনিক উৎপাদন প্রক্রিয়া, ডিজাইন বা মান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের সংখ্যা খুব কম। দক্ষতার অভাবে উৎপাদন খরচ বাড়ে, মান কমে, আর প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হয়। সব মিলিয়ে দেখা যায়, চামড়াশিল্পের সংকট কেবল অর্থনৈতিক নয়- এটি একটি পরিবেশ, নীতি, প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার সমন্বিত সমস্যা, যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও আন্তরিক প্রয়াস প্রয়োজন।

বাংলাদেশের চামড়াশিল্পে সংকট থাকলেও এর সম্ভাবনা এখনও উজ্জ্বল। সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সরকার, উদ্যোক্তা, শ্রমিক সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা এই শিল্পকে আবারও দেশের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনৈতিক খাতে পরিণত করতে পারে। চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ব্যবহার অপরিহার্য। সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যৌথ উদ্যোগে ট্যানারি এলাকাগুলোতে আধুনিক মেশিন, গবেষণাগার ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। এর ফলে উৎপাদনের মান ও গতি দুটোই বাড়বে। সরকারকে এই খাতে উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান করতে হবে। রপ্তানিকারকদের জন্য কর-ছাড় ও প্রণোদনা বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে চামড়াশিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে।

চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, ডিজাইন, প্যাকেজিং ও বিপণন বিষয়ে প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। পেশাগত শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তরুণদের এই খাতে আকৃষ্ট করা গেলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হবে। শুধু সরকারি উদ্যোগ নয়, উদ্যোক্তা ও শ্রমিকদের মধ্যে বোঝাপড়া ও সমন্বয়ও জরুরি। একটি স্থায়ী নীতিমালা তৈরি করে চামড়াশিল্পের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।


ফারিহা জামান নাবিলা : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা