সংস্কার ও বিনির্মাণে ছাত্র সমাজ
‘যেখানে অন্যায়, সেখানেই ছাত্র আন্দোলনের গর্জন।’ বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবময় ও সংগ্রামমুখর। ছাত্ররা অন্যায়, শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। গোটা জাতির অধিকার আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৫২ : ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ : যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ : শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ : ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ : গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ : মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ : স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ২০০৭-০৮ : ওয়ান-ইলেভেন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ২০২৪ : জুলাই-আগস্টের বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে অবিস্মরণীয়, অনন্য। জুলাই বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল- একটি মুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক, নিরাপদ ও আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ গঠন। যেই গণ-আন্দোলনে ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ, ১৭ জুলাই ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স টেকনোলজির কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ের মেধাবী ছাত্র শাইখ আস-হা-বুল ইয়ামিন, মুগ্ধসহ প্রায় ১৫০০ তাজা প্রাণ ঝরে যায়। অসংখ্য ছাত্র ও সাধারণ জনতা পঙ্গুত্ব বরণ করেন। ছাত্রদের ডাকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েন। অবশেষে জুলাই বিপ্লব ও ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের শাসক দলকে বিদায় নিতে হয়।
বাংলাদেশ সংস্কার ও বিনির্মাণে যে ছাত্র সমাজ আকাশছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার প্রতীক সেই ছাত্র সমাজের বর্তমান পরিস্থিতি : সংকট ও আদর্শচ্যুতি, ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় ঐতিহ্যকে কলুষিত করছে। বর্তমানে দেশজুড়ে ছাত্রদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজমান। দেশপ্রেমের অভাব ও স্বার্থান্বেষী মনোভাব স্পষ্ট। এতে প্রগতিশীল ছাত্র সমাজের মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। প্রগতিশীলতার অর্থ শুধু সরকারবিরোধিতা নয়, বরং সত্য, ন্যায় ও শিক্ষার পক্ষে দাঁড়ানো। বর্তমান ছাত্র সমাজের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম লক্ষ করা যাচ্ছে, যা পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অধিকাংশ শিক্ষার্থীর যেসব সমস্যা দেখা যায় (যেমন- ক্লাসে মোবাইল, অনলাইন মাল্টিপ্লেয়ার গেমিং, বিভিন্ন ভায়োলেন্ট মুভি, পর্নোগ্রাফি, ফ্রি-ফায়ার, সহিংস কনটেন্ট, নকল), মাদক সেবন বা ধূমপান, কেউ কেউ বন্ধুদের প্রভাব বা রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছুরি-চাকুসহ ভারী অস্ত্র বহন ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে, ক্লাসে অমনোযোগী, স্কুল পালানো, শিক্ষককে অসম্মান নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া বাহ্যিক সাজসজ্জা ও স্টাইলের প্রতি অতি আগ্রহ শিক্ষার প্রতি উদাসীনতা তৈরি করছে। কিছু সংঘবদ্ধ ছাত্রগোষ্ঠীর অপতৎপরতার শিকার হচ্ছে নিরীহ শিক্ষার্থীরা। তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে আক্রমণ করে ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে থাকে। অলস ও দায়িত্বহীন মানসিকতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা অটোপাস বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের দাবিতে আন্দোলনে নামে, এসব শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজ কিংবা রাস্তাঘাটে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, কটূক্তি করা, অনুসরণ করা, অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা এসব ইভটিজিং করে থাকে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক প্রবণতা হচ্ছে প্রেম বা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে কেন্দ্র করে সহপাঠীদের মধ্যে বিরোধ। আর এই বিরোধের সূত্র ধরেই হাতাহাতি, মারামারি, দলে দলে সংঘর্ষ এমনকি ধারালো অস্ত্র ব্যবহারের মতো ভয়াবহ রূপ নেয়। এই নৈতিকতা ও চরম অবক্ষয়ের প্রতিবাদ যদি কোনো শিক্ষক করেন, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষকের অপমানিত, লাঞ্ছিত এমনকি শারীরিকভাবে আঘাতের মতো গর্হিত ও ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটতে দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক চাপ, কখনও অভিভাবকদের প্রভাব, আবার কখনও নিজেই নিরাপত্তহীনতার কারণে আর বিভিন্ন বিধি-নিষেধের জাঁতাকলে স্কুল-কলেজ প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। তাদের নীরবতায় অপরাধীরা উৎসাহিত হয়ে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলার পরিবেশ নষ্ট করার সুযোগ পাচ্ছে। অভিভাবকরাও সন্তানের কাছে নিরুপায়। আবার কিছু কিছু অভিভাবক সন্তানের পক্ষাবলম্বন করে শিক্ষকের বিরুদ্ধে মারমুখী ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এই ধরনের ঘটনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশকেই কলুষিত করছে না, বরং শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য- জ্ঞান, শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধকে তারা নষ্ট করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সৌহার্দপূর্ণ, আন্তরিক হৃদ্যতাপূর্ণ, আনন্দদায়ক, চিত্তাকর্ষক, ভীতিহীন ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
অতীতে বিভিন্ন অধিকার আদায়ে ক্লাসের মেধাবী শিক্ষার্থীদের রাজপথে দেখা যেত। বর্তমান প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। একটি রাষ্ট্র কোনদিকে যাচ্ছে, কতটুকু উন্নত হবে তা বোঝা যায় তার শিক্ষাসংক্রান্ত কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে। শিক্ষা হলো জাতির উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। শিক্ষার মান বাড়লেও সুশিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ। সুশিক্ষিত জাতিই পারে অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানবিক, নৈতিকভাবে অগ্রসর হতে। একজন শিক্ষার্থীর প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করা। এতে চিন্তা-চেতনা, মনমানসিকতা ও রুচিবোধের পরিবর্তনের মাধ্যমে সভ্য সমাজ গঠিত হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে। শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ার গড়ে বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে অগ্রগতি ঘটানো দরকার। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণ ধারা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করে মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা অর্জন করতে পারে। শিক্ষায় প্রযুক্তি, কারিগরি শিক্ষা, ডিজিটাল লার্নিং, আন্তর্জাতিক মান ও আধুনিকতার ছোঁয়া দরকার। আমাদের দেশের চিকিৎসাসেবার মান আশানুরূপ নয়। উচ্চবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্তরাও উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে যান। চিকিৎসকের মান উন্নত হলেও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধিতে কাজ করা প্রয়োজন। না হলে এ বিপ্লবের সুফল জনগণ পাবে না, কেবলই ইতিহাস হয়ে থাকবে। তাদের গৌরবময় ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার মাধ্যমে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি, বিবেক, নীতি-নৈতিকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে বর্তমান সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। সামাজিক অস্থিরতা কাটিয়ে সুশিক্ষা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে আমাদের ছাত্ররা সমাজ, দেশ ও সর্বোপরি বিশ্বকে আলোকিত করুক- এটাই প্রত্যাশা।
বাংলাদেশের স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সমাজের সবচেয়ে অগ্রগামী অংশ ছাত্র সমাজকে শিক্ষামুখী হতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন মহলকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
পারভীনা খাতুন : গবেষক ও শিক্ষক, যশোর শিক্ষা বোর্ড সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, যশোর
মতামত লেখকের নিজস্ব
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?