ভেনিজুয়েলায় মার্কিন হস্তক্ষেপে সতর্কবার্তা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির এক পুরনো রোগের নাম ‘সরকার পরিবর্তন’ বা ‘রেজিম চেঞ্জ’, যা লাতিন আমেরিকার মাটিতে বহুবার বিষাক্ত ফল ফলিয়েছে। চিরায়তভাবে বামপন্থি শক্তিগুলো ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ বলে যে স্লোগান দিত, তা দুই দশক ধরে কিছুটা স্তিমিত মনে হলেও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে সেই পুরনো ভূত আবারও সজোরে ফিরে এসেছে। একসময় ধারণা করা হয়েছিল, স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ও একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হয়তো ওয়াশিংটন তার এই আগ্রাসী মনোভাব থেকে সরে এসেছে এবং ভিনদেশি সরকার পরিবর্তনে তারা আর প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করবে না। কিন্তু সে ধারণা যে ভুল, তার সাম্প্রতিকতম এবং ভয়াবহ নজির হলো তেলসমৃদ্ধ দেশ ভেনিজুয়েলা। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন কর্তৃক সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিকে (সিআইএ) ভেনিজুয়েলায় ‘গোপন অভিযানের’ অনুমোদন দেওয়া এবং দেশটির জলসীমায় একের পর এক প্রাণঘাতী সামরিক হামলা সেই পুরনো সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের নীলনকশা পরিষ্কার করে তুলেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সরাসরি স্বীকারোক্তি এবং সামরিক পদক্ষেপের ক্রমিক উত্থান- দুইয়ে মিলে ভেনিজুয়েলার পরিস্থিতিকে এক বিপজ্জনক মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জনসমক্ষে দুটি কারণে এই পদক্ষেপের ন্যায্যতা দিয়েছেন : প্রথমত, ভেনিজুয়েলা তাদের কারাগার খালি করে অপরাধীদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাচ্ছে; এবং দ্বিতীয়ত, মাদক পাচার, যার বেশির ভাগই সমুদ্রপথে আসছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব দাবির পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ কোথায়? মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন পর্যন্ত এই দাবির সপক্ষে কোনো জোরালো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। বরং এই ‘মাদকবিরোধী অভিযান’-এর আড়ালে মূল লক্ষ্য যে ভেনিজুয়েলার বামপন্থি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং দেশটির বিশাল তেলসম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, তা মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর এবং প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ মহলের বক্তব্যে সুস্পষ্ট। নিউইয়র্ক টাইমস পর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশল মূলত মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ওপর কেন্দ্রীভূত।
গত কয়েক সপ্তাহে ক্যারিবীয় সাগরে ভেনিজুয়েলার নৌযানগুলোর ওপর মার্কিন সামরিক বাহিনীর একাধিক হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের গুরুতর লঙ্ঘন। ওয়াশিংটন প্রতিটি হামলায় দাবি করেছে, এগুলো ছিল ‘মাদকবাহী নৌকা’, কিন্তু হামলায় মোট ২৭ জন মানুষের মৃত্যুর পরও তারা এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, সমুদ্রপথে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সমুদ্র আইন (আনক্লস) ও ১৯৮৮ সালের মাদক পাচারবিরোধী কনভেনশন অনুযায়ী ‘জীবনের অধিকার’, ‘আইন প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা’ এবং ‘সামঞ্জস্যের নীতিমালা’ কঠোরভাবে মানতে হয়। এগুলো ধ্বংস বা হত্যার কথা বলে না, বরং সহযোগিতা ও তল্লাশির কথা বলে- যা এসব ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত।
খোদ যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক আইনজীবী ব্রুস ফাইন আরও স্পষ্টভাবে বলেন, আত্মরক্ষার পরিস্থিতি ছাড়া কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিতে হলে কংগ্রেসের প্রকাশ্য অনুমোদন জরুরি। অথচ ১৯৭৩ সালের ওয়ার পাওয়ারস রেজ্যুলেশন অনুযায়ী প্রেসিডেন্টকে সামরিক পদক্ষেপের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কংগ্রেসকে জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভোট বা অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসন মাদুরো সরকারকে মাদকচক্রের পেছনে থাকার অভিযোগ তুললেও এই ঘোষণা ‘আইনবিরোধী’ হিসেবে সমালোচিত হয়েছে, কারণ এটি সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণার জন্য নির্ধারিত সাংবিধানিক মানদণ্ড পূরণ করে না। মাদুরো সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপকে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘সরকার পরিবর্তনের বৈধতা’ সৃষ্টির চেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, যা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে যথেষ্টই যৌক্তিক ও ঐতিহাসিক পুনরাবৃত্তি।
এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসব গোপন তৎপরতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবহারের হুমকিকে ভেনিজুয়েলার সার্বভৌমত্ব এবং জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন বলে সতর্ক করেছেন। তারা লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে বাহ্যিক হস্তক্ষেপের পুনরাবৃত্তি না করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি স্পষ্ট যে, ভেনিজুয়েলায় যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কেবল ‘মাদকবিরোধী অভিযানের’ আড়ালে নয়, বরং রেজিম চেঞ্জ, ভূ-রাজনৈতিক দখল ও আধুনিক হেমিস্ফিয়ার নিয়ন্ত্রণের একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তবে মার্কিন আগ্রাসন এবং আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি যে শক্তিশালী প্রতিরোধ দেখাচ্ছে, তা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং পশ্চিমের একাধিপত্যের বিপরীতে এক নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জোর দিয়ে বলেছে, মার্কিন আগ্রাসন, ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র, অবরোধ, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ও যুদ্ধের হুমকির ভেতরেও এই ধারাবাহিকতা দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে স্থিতিশীল করেছে। এই অর্থনৈতিক সাফল্য কেবল একটি সংখ্যা নয়, বরং এটি জাতীয় ঐক্যের প্রতিফলন এবং ‘বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব’ ধারণার এক বাস্তব প্রমাণ। রাশিয়া, চীন, ইরান এবং অন্যান্য সহযোগী দেশের সঙ্গে ভেনিজুয়েলার বাণিজ্য সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অবরোধের অস্ত্রকে কার্যত অকার্যকর করে দিয়েছে। কিউবা, ইরান, উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলো প্রমাণ করেছে যে, একসময়কার ‘এককেন্দ্রিক’ বিশ্বব্যবস্থা এখন আর সেভাবে কাজ করে না। ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি যদি এই প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে পারে, তবে ২০২৬ সালে প্রায় ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে, যা পশ্চিমের আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর জন্য এক বড় মাথাব্যথার কারণ।
মার্কিন প্রশাসনের এই ‘নিয়ন্ত্রণ হারানোর’ আশঙ্কা থেকেই সামরিক হুমকি এবং সিআইএ-এর গোপন অভিযানের মতো মরিয়া পদক্ষেপগুলো আসছে। তবে এতে বিপরীত ফল ফলবে বলেই রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ট্রাম্পের ঘোষণা মাদুরোর রাজনৈতিক ঘাঁটিকে আরও ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করতে পারে, যা লাতিন আমেরিকার ‘ঔপনিবেশিকবিরোধী’ ঐতিহ্যকে জোরদার করবে। তবে একই সঙ্গে এটি অভ্যন্তরীণ নজরদারি ও দমননীতি বাড়িয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে।
ভেনিজুয়েলায় মার্কিন হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও শিক্ষণীয় হতে পারে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো যে কোনো সময় হস্তক্ষেপ করতে পারে, সেটা হতে পারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ, ভিসা নিষেধাজ্ঞা, গোপন অভিযান, সমুদ্রে অবস্থান গ্রহণ, নিরাপত্তা সহযোগিতার নামে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো ইত্যাদি নানা নামে নানাভাবে এই প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা হতে পারে। বাংলাদেশেও এই আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে, যেখানে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে।
এখানে মনে রাখা দরকার যে, একাধিক শক্তিভিত্তিক বিশ্বে এক দেশ-এক শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বিপজ্জনক হতে পারে। ভেনিজুয়েলায় যেমন দেখা গেছে, একমুখী নির্ভরতা ও প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিদের উপস্থিতি দেশকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের তেমন নীতি থেকে সরে এসে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে।
আরও একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, রাজনৈতিক উত্তেজনায় অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হতে পারে। বিদেশি অবরোধ, উৎপাদন শৃঙ্খলায় বিঘ্ন, ইউরোপ-আমেরিকার বাজার থেকে বিচ্ছিন্নতা- এসব ভেনিজুয়েলায় মার্কিন হস্তক্ষেপের পরিণতি হতে পারে। এটি আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। সবচেয়ে বড় কথা, হস্তক্ষেপের কারণে সব সময় সাধারণ জনগণই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে কোনো সংকটে মানবাধিকার ও নাগরিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্থানীয় নীতিনির্ধারকদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ভেনিজুয়েলার অভ্যন্তরীণ সামাজিক অর্থনৈতিক জটিলতা, বিদেশি হস্তক্ষেপ ও স্থানীয় রাজনৈতিক সংকট- সব মিলিয়ে একটি খুব ভঙ্গুর-দুর্গম পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে মার্কিন হস্তক্ষেপ আগ্রাসনের এক পুরনো চাল- ‘সরকার পরিবর্তন’ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণের এক মরিয়া চেষ্টা। কিন্তু মাদুরো সরকারের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে তাদের প্রতিরোধ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পুরনো কৌশলকে নতুন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক
মতামত লেখকের নিজস্ব