সমন্বিত উদ্যোগ নিন
পোশাকশিল্পে বিপর্যয়
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান ভরসা পোশাকশিল্প। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে এই খাত থেকে। প্রায় এক কোটি মানুষÑ যার অধিকাংশই নারী-এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থেকে জাতীয় অর্থনীতিকে সচল রাখছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই গুরুত্বপূর্ণ খাত নানা ধরনের সংকটে জর্জরিত। শ্রমিক অসন্তোষ, বৈদেশিক অর্ডার হ্রাস, জ্বালানি ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, পাশাপাশি পরিবেশগত ঝুঁকিÑ সব মিলিয়ে পোশাকশিল্প এখন কঠিন এক পরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়ে।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো- সম্প্রতি শ্রমিক অসন্তোষ, সংঘর্ষ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) শিল্পপরিবেশ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে, বাড়ছে বেকার শ্রমিকের সংখ্যা। কেবল গত এক বছরে চট্টগ্রামে অর্ধশতাধিক ছোট-বড় পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক। এর মধ্যে চলতি অক্টোবর মাসেই বেকার হয়েছেন প্রায় ৪০ হাজার। দেশের বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিনস গ্রুপ তাদের আটটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। এতে ৩৫ হাজার শ্রমিক একদিনে বেকার হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বহু বছর ধরে সফলভাবে রপ্তানি করা প্যাসিফিক জিনসের মতো গ্রুপে বারবার অস্থিরতা দেখা দিলে তা দেশের সামগ্রিক পোশাকশিল্পের ওপর আঘাত আসতে পারে। কাছাকাছি সময়ে সিইপিজেডের অ্যাডামস ক্যাপস ও জিহং মেডিক্যাল প্রডাক্টসের আটতলা ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। হাজার কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, প্রায় ৩ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই দুই ঘটনার ধাক্কা পুরো চট্টগ্রাম শিল্পাঞ্চলের উৎপাদন ও রপ্তানি পরিস্থিতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
মূলত চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৫৮০টি পোশাক কারখানার মধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে ৫২৮টি। ফলে এই অঞ্চলে বিনিয়োগ কমছে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
চট্টগ্রামের সংকট যদি ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে পুরো দেশের অর্থনীতিতে তা মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। বিদেশি ক্রেতারা ইতোমধ্যে শ্রমিক অস্থিরতা ও অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও এসব সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের রপ্তানি ভাবমূর্তির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হয়ে পড়লে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
একই সঙ্গে এই সংকট সামাজিক অস্থিরতারও কারণ হতে পারে। কয়েক হাজার শ্রমিক একসঙ্গে চাকরি হারালে তাদের পরিবারসহ কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা হারানোর ঝুঁকিতে পড়ে। খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজন মেটানো তখন কঠিন হয়ে পড়ে।
এখন প্রয়োজন তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। সরকারকে শ্রমিক, মালিক ও প্রশাসনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় ঘটাতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ কমিয়ে পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ নীতিতে নমনীয়তা, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের খরচ নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানি নীতিতে প্রণোদনা দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে আছে শ্রমিকদের শ্রম, উদ্যোক্তাদের মেধা ও সরকারের নীতিগত সহায়তায়। কিন্তু এখন সেই সাফল্যের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখতে হলে শিল্পাঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক পুনর্গঠন জরুরি। চট্টগ্রামের ঘটনার পর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। আস্থা ফিরিয়ে আনতে ন্যায্য ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।