সড়ক নিরাপত্তা ব্যর্থ হচ্ছে আইনের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও প্রশাসনিক সংস্কৃতির দুর্বলতায়

রণজিৎ সরকার
২২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সড়ক নিরাপত্তা ব্যর্থ হচ্ছে আইনের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও প্রশাসনিক সংস্কৃতির দুর্বলতায়


ড. এম শামসুল হক পরিবহন বিশেষজ্ঞ। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক। ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে তিনি ‘আমাদের সময়’কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে নিরাপদ সড়ক, চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সিং, সড়ক আইন, নগর পরিকল্পনা, সড়ক অবকাঠামো এবং দুর্ঘটনা রোধে কৌশলগত পরিকল্পনাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার মতামত তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রণজিৎ সরকার

আমাদের সময় : দেশে ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে আপনি বর্তমান পরিস্থিতি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

এম শামসুল হক : দেশে সড়ক দুর্ঘটনার বর্তমান হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পরিস্থিতির গভীরতা বোঝার জন্য শুধু সংখ্যাই নয়, এর সামাজিক প্রভাবও দেখতে হবে। বিশেষ করে লক্ষণীয় যে, দুর্ঘটনায় নিহতদের একটি বিশাল অংশই তরুণ ও যুবক, যারা তাদের পরিবারের প্রধান আয়রোজগারি। তাদের হারানো মানে একটি পরিবারের আর্থিক ভিতই নড়ে যাওয়া। বর্তমানে মোটরসাইকেলের ব্যাপক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে তরুণ প্রজন্মই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন সর্বাধিক, যা মোট আহত ও নিহতের প্রায় ৩৫ শতাংশ। এটি কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিই নয়, বরং এটি একটি গভীর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষতির কারণ। সামগ্রিকভাবে, সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জন্য একটি গুরুতর জাতীয় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের সময় : প্রতিবছরই ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’ পালন করা হয়। অথচ সড়কে প্রাণহানি কমছে না কেন?

এম শামসুল হক : এটি একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন। আমরা দেখি প্রতিবছর ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’ বেশ ঘটা করেই পালিত হয়, অথচ সড়কে প্রাণহানির মাত্রা আশানুরূপ কমছে না। এর মূল কারণ হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা পালনের প্রতি একটি প্রবল ঝোঁক আছে, কিন্তু বাস্তব কাজটি করার প্রতি দায়িত্ববোধের অভাব রয়েছে। গত প্রায় চার দশকের পেশাগত জীবনে আমি দেখেছি, অসংখ্য কমিটি গঠন করা হয়েছে, বিশদ রিপোর্ট ও সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে। গত সরকারের সময়েই উদাহরণস্বরূপ, ১২টি মন্ত্রণালয়কে নিয়ে ১১১টি সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এসব উদ্যোগ প্রায়ই আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডি পেরিয়ে যায় না। যাদের হাতে বাস্তবায়নের দায়িত্ব, তারা প্রায়ই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন।

এখানে জবাবদিহিতার সংকট একটি বড় বিষয়। অনেক সময় দেখা যায়, প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সুবিধাই প্রাধান্য পায়, জনসাধারণের স্বার্থ নয়। এর ফলে সুপারিশের অভাব হয় না, বরং সেগুলো জমে জমে এক প্রকার ‘অতিরিক্ত সুপারিশ’-এর সৃষ্টি হয়, কিন্তু সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন হয় না। আমাদের এখন আনুষ্ঠানিকতা থেকে সরে এসে দায়িত্বশীলতা ও কার্যকর বাস্তবায়নের দিকে মনোনিবেশ করা জরুরি।

আমাদের সময় : সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে আপনারা কি বাধার সম্মুখীন হন?

এম শামসুল হক : সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি একটি বড় অন্তরায়। যেমনÑসড়ক মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় বা বিআরটিএ’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট তৎপর নয়। তারা আলোচনায় একসঙ্গে কাজ করার কথা বলেন, কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর হয় না। দায়িত্বশীল মনোভাব ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের অভাবে সড়ক নিরাপত্তার অবস্থা এখনও আশানুরূপ উন্নত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প প্রণয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে, পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।

আমাদের সময় : চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন?

এম শামসুল হক : চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় গুণগত সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে বিআরটিএ কম্পাউন্ডে সীমিত পরীক্ষা (যেমন জিগ-জ্যাগ বা ল্যাম্প টেস্ট) প্রকৃত দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য যথেষ্ট নয়। একটি অর্থপূর্ণ পড়সঢ়বঃবহপু ধংংবংংসবহঃ-এর জন্য অবশ্যই বাস্তব সড়ক পরিস্থিতিতে চালকের ঢ়বৎভড়ৎসধহপব মূল্যায়ন আবশ্যক, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে প্রকৃত ট্রাফিকের মধ্যে গাড়ি চালানো, রাস্তার চিহ্ন ও মার্কিং বোঝা, সক্রিয় সড়কে সুরক্ষিতভাবে পার্কিং করার দক্ষতা এবং অন্যান্য ব্যবহারিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সক্ষমতা। শুধু একটি ধষষ-রহপষঁংরাব এবং বাস্তবসম্মত পরীক্ষা পদ্ধতিই একজন চালকের প্রকৃত যোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে অনিয়ম দূর করতে হবে। টাকার বিনিময়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা বন্ধ করতে হবে। এজন্য একটি কার্যকর সমাধান হলো, দেশের সব ফিটনেস সেন্টারে সিসি ক্যামেরা বাধ্যতামূলক করা। এটি একটি স্বচ্ছ ব্যবস্থা চালুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই বিষয়ে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি ফিটনেস সেন্টারগুলোতে সিসি ক্যামেরা বসানোর নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হয়, তাহলেই কেবল দায়িত্বশীলতা প্রমাণিত হবে। অন্যথায় এই অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই দায়ী বলে বিবেচিত হবেন। সামগ্রিকভাবে এই পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই হলো সবচেয়ে বড় সংস্কার।

আমাদের সময় : বর্তমান আইন সড়ক নিরাপদ করতে পারছে না কেন? প্রতিবন্ধকতা কোথায়?

এম শামসুল হক : বর্তমান সড়ক আইন সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ আইনের কাঠামোগত ত্রুটিতে নয়, বরং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও প্রশাসনিক সংস্কৃতির দুর্বলতায় নিহিত। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রকৃত কর্মদক্ষতার চেয়ে প্রকল্পনির্ভর চিন্তার ব্যক্তিদের আধিক্য দেখা যায়Ñ যেখানে ‘পদ’ মানে দায়িত্ব নয়, বরং ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনের মাধ্যম। পদবি থাকলেও দায়িত্বশীলতা অনুপস্থিত।

বিআরটিএ, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের মতো সংস্থাগুলো নিয়মিত দায়িত্ব পালনের চেয়ে দুর্ঘটনার পর টোকেন কার্যক্রম বা মৌসুমি সচেতনতামূলক প্রদর্শনীতে বেশি সক্রিয়। এই প্রবণতার মূলেই রয়েছে জবাবদিহিতার অভাবÑ=- যেখানে দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়াতেই ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষিত হয়। ফলে সুপারিশের ঘাটতি নয়, বরং দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতিই সড়ক নিরাপত্তা আইনকে কার্যকরভাবে প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করছে।

আমাদের সময় : আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নিরাপদ সড়ক গড়তে বাংলাদেশকে আসলে কোন দিকগুলোয় মনোযোগী হতে হবে?

এম শামসুল হক : আন্তর্জাতিক মানের নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশকে কয়েকটি মৌলিক ক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে হবে। প্রথমত, ড্রাইভার প্রশিক্ষণ ও গাড়ির ফিটনেস ব্যবস্থাপনায় গুণগত সংস্কার প্রয়োজন। গাড়ির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও সরকারি ইন্সট্রাক্টর ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা সেই হারে বাড়েনি, যা একটি গতিশীল ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা হওয়া উচিত নিয়ন্ত্রক ও তত্ত্বাবধায়কের। দেশজুড়ে বেসরকারি পর্যায়ে অনুমোদিত ওয়ার্কশপ ও সার্ভিস সেন্টার স্থাপন করতে হবে, যারা নির্দিষ্ট এলাকার গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদান করবে। সরকারের দায়িত্ব হবে নিয়মিত চেকিং পরিচালনা করা এবং কোনো অবৈধ কার্যকলাপ ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা।

একইভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। লাইসেন্স ইস্যুর আগে তিন স্তরের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবেÑ তাত্ত্বিক জ্ঞান, সীমিত এলাকায় দক্ষতা এবং বাস্তব সড়কে ব্যবহারিক পরীক্ষা। ট্রাফিক পুলিশকে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সজ্জিত করতে হবে, যাতে তারা যে কোনো ড্রাইভার বা গাড়ির তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করতে পারে।

শুধু আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাই মূল চ্যালেঞ্জ। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ ও সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে। একটি স্বচ্ছ, প্রযুক্তিভিত্তিক ও জবাবদিহিতামূলক কাঠামোই কেবল আন্তর্জাতিক মানের নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে।

আমাদের সময় : নগর পরিকল্পনা ও সড়ক অবকাঠামোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা কতটা প্রভাব ফেলেছে এই দুর্ঘটনার ওপর?

এম শামসুল হক : নগর পরিকল্পনা ও সড়ক অবকাঠামোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা সড়ক দুর্ঘটনার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যেমন হাতিরঝিল প্রকল্পে রাস্তার পাশে দোকান গড়ে ওঠার প্রবণতা রোধে ব্যক্তিগত জমির সামনে দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল, যাতে ভূমির ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং সড়কের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কার্যক্রম না ঘটে। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভূমি ব্যবহারের সঠিক নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য, যা শুধু ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট দিয়ে সম্ভব নয়। যদি সড়কের পাশে ভূমি ব্যবহারে বিশৃঙ্খলা থাকে, তাহলে দুর্ঘটনা ও যানজট অনিবার্য। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সড়ক, ভূমি ব্যবহার এবং যানবাহন ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা মেগা প্রকল্পে আগ্রহী হলেও সমন্বিত উন্নয়নের বিজ্ঞান বুঝি নাÑ ফলে উন্নয়ন হয়, কিন্তু তা টেকসই বা নিরাপদ নয়। পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য সড়ক ও তার পার্শ্ববর্তী ভূমির ব্যবহারকে একত্রে রেগুলেট করতে হবে, নইলে প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পই সড়কের বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনার মাত্রা বাড়াবে, যা কখনই সামগ্রিক উন্নয়ন বলা যাবে না।

আমাদের সময় : সম্প্রতি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এবং পাশাপাশি যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রাস্তায় বিশৃঙ্খলভাবে চলাচল করছেÑ এতেও দুর্ঘটনা বাড়ছে। প্রতিরোধে সরকারের কোনো নতুন পরিকল্পনা আছে?

এম শামসুল হক : মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার (ইজিবাইক) অনিয়ন্ত্রিত চলাচল সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার হার বাড়িয়ে তুলেছে। এই সংকটের মূল কারণ হলোÑ প্রথমেই ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া। সরকার চাইলে বিআরটিএর মাধ্যমে শুরুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, কিন্তু ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিস্তার ও ঝুঁকি বিবেচনায় তা করা হয়নি। পেশাদার সংস্থা হলে বুঝত যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে লাখ লাখ ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

বর্তমানে এই যানবাহনগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনা অত্যন্ত কঠিন, কারণ তাৎক্ষণিক সমাধান দিলে রাষ্ট্রে বড় ধরনের অস্থিরতা ও ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করতে হবে। কলকাতার উদাহরণে দেখা যায়, সেখানে সরকার দুই বছর সময় নিয়ে রিকশা ও এক্কা গাড়ি সরিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশেও তেমন সময়সীমা নির্ধারণ করে, ধারাবাহিক ও পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। জটিকা বা মৌসুমি পদক্ষেপে কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয় নিয়ন্ত্রণের জন্য চাই বছরব্যাপী সুসংহত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।

আমাদের সময় : সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে আসলে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

এম শামসুল হক : সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। পরিবহন একটি বিশেষায়িত বিষয়, যা সাধারণ জ্ঞান বা আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পরিচালনা করা যায় না। আজকের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মূলত দায়িত্বপ্রাপ্তদের অযোগ্যতার ফল। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এমন প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, যেখানে বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন, দায়িত্বশীল এবং নন-ট্রান্সফারেবল জনবল থাকবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধারাবাহিকতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবেÑ প্রতিটি ফাইলের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। সড়ক ব্যবস্থাপনায় যদি সত্যিই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা ও জ্ঞানের ভিত্তিতে একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

আমাদের সময় : দুর্ঘটনা রোধে আমাদের দেশের ফুটওভারব্রিজ কতটা কাজে লাগে?

এম শামসুল হক : ফুটওভারব্রিজ দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর নয়, কারণ বাস্তবে মানুষ এগুলো ব্যবহার করে না। উন্নত দেশগুলো যেমন জাপান ও আমেরিকায় ফুটওভারব্রিজের ব্যবহার নেই বললেই চলে। উন্নত দেশগুলোতে অন্তর্ভুক্তিমূলক সড়ক নিরাপত্তা উদ্যোগের আওতায় পথচারীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সেখানে সড়ক পারাপারের জন্য সিগন্যাল-নিয়ন্ত্রিত, সমতল (ধঃ-মৎধফব) ক্রসিং ব্যবস্থা রাখা হয়, যাতে যানবাহনের গতি থামিয়ে পথচারীদের নিরাপদে পারাপার নিশ্চিত করা যায়। এই ব্যবস্থায় সবার জন্য শারীরিকভাবে সক্ষম ও বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য সর্বজনীন প্রবেশযোগ্যতা নিশ্চিত করা হয়। কাউকে রাস্তার উচ্চতা পরিবর্তন করে ফুটওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয় না। ফলে পথচারী নিরাপত্তা, সম্মান ও স্বাধীনতা রক্ষা পায়, যা একটি মানবিক ও আধুনিক নগর ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

আমরা অনেক সময় বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ছাড়া অজ্ঞতাবশত ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করি, অথচ পরে পথচারীরা তা ব্যবহার না করলে তাদেরই দোষারোপ করি। বাস্তবতা হলোÑ এই অবকাঠামোগুলো নির্মাণের পর সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণও করা হয় না। আমাদের আগ্রহ থাকে শুধু নির্মাণে, কার্যকর ব্যবস্থাপনায় নয়। ফলে ফুটওভারব্রিজগুলো অচল, অপ্রবেশযোগ্য কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে, যা পথচারীদের জন্য ব্যবহারযোগ্য থাকে না। সড়ক নিরাপত্তায় প্রকৃত সুফল পেতে হলে শুধু নির্মাণ নয়, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারযোগ্যতা নিশ্চিত করাও জরুরি।

আমাদের দেশে সমস্যা হলো দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার ঘাটতি। মানুষকে দোষারোপ না করে, আমাদের মানসিকতা ও পরিকল্পনার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে সফল হতে হলে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে। অন্যথায় যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে পরিবহনসংক্রান্ত সমস্যাগুলো ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের চাপে আরও জটিল হয়ে উঠবে। এই অবহেলা ও নিষ্ক্রিয়তার খরচ একসময় এমন মাত্রায় পৌঁছাবে, যা ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়বেÑ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং ব্যবস্থাপনাও হবে অসম্ভব। তাই সময়মতো বিজ্ঞানভিত্তিক, সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণই একমাত্র পথ, যাতে নগর ও পরিবহন ব্যবস্থাকে টেকসই ও মানবিক রাখা যায়।

আমাদের সময় : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এম শামসুল হক : আপনাকে ধন্যবাদ।