শিক্ষা পদ্ধতির সংস্কার জরুরি
শিক্ষাক্ষেত্রে তুমুল প্রতিযোগিতার কালে আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার মানসিকতা। পরীক্ষার খাতায় অধিক নম্বর প্রাপ্তিই যেন এখন শিক্ষার্থীদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণিতে এবং পড়ার টেবিলে সময় দেওয়ার চেয়ে প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সেন্টারে অধিক সময় দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। গাইড বইনির্ভর পড়ালেখার জন্য অবহেলা করা হচ্ছে মূল পাঠ্যবই।
সম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে সর্বনিম্ন পাসের হার দেখে সবার মাঝে তুমুল সমালোচনা চলছে। ব্যাপারটা হয়েছে গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার মতো। শিক্ষা পদ্ধতির যথাযথ সংস্কার না করে হঠাৎ খাতা মূল্যায়ন ও ফলাফল তৈরিতে কড়াকড়ির কারণেই ঘটেছে এমন ফলাফল বিপর্যয়। শিক্ষাক্রমে অনেক পরিবর্তন এলেও পরিবর্তন আসেনি পাঠদান প্রক্রিয়ায়। শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান প্রক্রিয়ায় বেশি বেহাল।
পরীক্ষার আগে বিগত সালের প্রশ্ন অনুসরণ করে নোট মুখস্থ করেই যেন চলছে পরীক্ষার প্রস্তুতি। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকরাই পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের এমন সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছন। এর ফলে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হচ্ছে। সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা নষ্ট হচ্ছে। আমাদের দেশের শিক্ষকদের স্বল্প বেতন এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা অব্যবস্থাপনাও তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণ। অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখন লাইব্রেরিতে যায় না বললেই চললে। খুব কম শিক্ষার্থীই নিয়মিত সংবাদপত্র পড়ে এবং টেলিভিশনে খবর দেখে। শিক্ষার্থীরা বেশি সময় ব্যয় করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসুস্থ বিনোদন দেখে এবং অনলাইন গেম খেলে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা থেকে পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকরা সন্তানের আগ্রহের কথা চিন্তা না করে জোর করে তাদের ওপর পড়ালেখা চাপিয়ে দেন। যার ফলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অনেক শিক্ষার্থী ঠিকভাবে খেলাধুলা ও শরীরচর্চার সুযোগই পায় না। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের চাহিদা ঠিকভাবে পূরণ হয় না। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের খাবার খুবই নিম্নমানের হয়ে থাকে। এছাড়া দেশের বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও সরঞ্জামের অভাবে কারিগরি শিক্ষার সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে এখন মান বাড়ানো বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষার্থীদের নানা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করতে হয়। প্রযুক্তিগত জ্ঞানের দিক থেকেও আধুনিক বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা ব্যাপক পিছিয়ে রয়েছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নেই উন্নত ল্যাব ও গবেষণাগার। পরীক্ষানির্ভর পড়ালেখার কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জ্ঞান শুধু একাডেমিক পড়ালেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। অথচ এ দেশে বিষয়ভিত্তিক চাকরির সুযোগ খুব কমই আছে। ফলে ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অসহায়ত্বে ভোগে। এমন শিক্ষাব্যবস্থার কারণে দেশে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে না। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, গত বছরের শেষে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ১০ হাজার। দেশের সব কর্মক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অযোগ্য কর্মীদের কারণে সঠিক উৎপাদন হচ্ছে না এবং কমে যাচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। শিক্ষা ও চাকরি ব্যবস্থার প্রতি বরাবরই মানুষের অনাস্থা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখন ব্যাপক হারে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে এবং অধিকাংশই পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরছে না। সম্প্রতি এক জরিপ অনুযায়ী, উন্নত জীবনের আশায় দেশের তরুণদের ৪২ শতাংশ বিদেশে পাড়ি জমাতে চান। এভাবে চলতে থাকলে দেশ অচিরেই মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্ভাবনা থাকলেও তা নষ্ট হয়ে যায় ফলাফলনির্ভর পড়ালেখার জন্য। খারাপ রেজাল্ট করার কারণে দেশে প্রতিবছরই অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখা ছেড়ে দেয়। অনেকেই হতাশায় পড়ে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
শিক্ষা দেশের জনসম্পদ তৈরির প্রধান কারখানা। এর ওপর নির্ভর করছে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন। তাই দেশের শিক্ষা পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
মো. জাহিদ হাসান : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
মতামত লেখকের নিজস্ব