গাজার শিশুদের প্রয়োজন ত্রাণ যা তাদের বাঁচিয়ে রাখবে
আমরা কয়েকদিন ধরে উদযাপনের পাশাপাশি বোমা ও বুলেটমুক্ত গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে সতর্ক আশাবাদের প্রকাশ দেখেছি। এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিরতি গাজার শিশুদের জন্য একটা সুযোগ তৈরি করছে যখন তারা মাথার ওপর ড্রোন, পাশের ভবনে বিমানহামলা কিংবা তাদের তাঁবুতে আগুন ধরে যাওয়ার শঙ্কা না নিয়ে ঘুমাতে যেতে পারবে। গাজার পরিবারগুলো ধীরে ধীরে তাদের এলাকায় ফিরে আসছে, ধ্বংসাবশেষ থেকে যা পারে উদ্ধার করার চেষ্টা করছে জীবনের প্রয়োজনে।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, পরিপূর্ণভাবে ত্রাণ আর অত্যন্ত জরুরি সেবা নেওয়ার সুযোগ এখনও পাচ্ছে না তারা। অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের শিশুদের জন্য এটা মৌলিক অধিকারের বিষয়, যার পক্ষে আমরা সুপারিশ করে চলেছি এবং কথা বলছি সেই ১৯৫৩ সাল থেকে।
গাজায় মানবিক পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। শিশুরা আর কোলের বাচ্চারা ভীষণভাবে ভুগছে পুষ্টিহীনতায়, আমাদের হেল্থ ক্লিনিকগুলোয় ডায়রিয়া, খোসপাঁচড়া আর নিউমোনিয়ায় আক্রান্তদের দেখতে পাচ্ছি ক্রমবর্ধমান হারে। এই মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত গাজা পুনর্নির্মাণের কথা চিন্তা করতে পারবে না ফিলিস্তিনিরা।
আমরা জানি, যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ায় জাতিসংঘের কয়েকটি সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর গাজায় মানবিক ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ বেড়েছে। কিন্তু শিশুদের কাছে প্রয়োজনীয় ত্রাণ পৌঁছানোর ধারেকাছেও নেই তা। সেই মার্চ মাস থেকে সেভ দ্য চিলড্রেনের ত্রাণসহায়তা গাজায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। একেবারে কম করে হলেও গাজায় পৌঁছানো দরকার ৬০০ ট্রাক ত্রাণ, ৫০টি জ¦ালানি ট্যাংকার আর রান্নার গ্যাস। শিশুদের দরকার সেসব ত্রাণসামগ্রী যা তাদের অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা পূরণ করবে। আমরা সাময়িক সমাধান হিসেবে বিদ্যমান মজুদ থেকে রেশনিং করে চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের জরুরি প্রয়োজন হচ্ছে অবিলম্বে, দীর্ঘ মেয়াদে পুষ্টিকর রসদ, খাবার, পানি, হাইজিন কিট যেমন সাবান, শ্যাম্পু, কাপড় কাচার ডিটারজেন্ট আর স্যানিটারি প্যাড পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ- সেই সঙ্গে জ¦ালানি, রান্নার গ্যাস এবং জীবনরক্ষার অন্যান্য অত্যাবশ্যক সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া।
প্রাথমিক ত্রাণ পৌঁছে দিতে না পারলে কী হয় সেটা আমরা দেখেছি। গাজার চার সন্তানের মা ৩০ বছর বয়সী নাজেক গর্ভবতী ছিলেন যুদ্ধের প্রথম বছরে, খাদ্যের অভাবে তিনি পুষ্টিহীনতার কবলে পড়েন। তার ছোট মেয়ে নূর সাত মাস বয়সে ভয়ংকর পুষ্টিহীনতার শিকার হয়। সেভ দ্য চিলড্রেনের নিউট্রিশন ক্লিনিকের সহায়তায় নূরের কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও তার অবস্থা ভঙ্গুর; প্লুম্পি’নাট নামে পরিচিত সম্পূরক থেরাপিউটিক ফুড দিয়ে তাকে কোনোরকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। তবে তার ধারাবাহিকভাবে প্রয়োজন উচ্চশক্তিসম্পন্ন পুষ্টিঘন খাবার এবং দীর্ঘ মেয়াদে।
শীতকাল আসন্ন, তাপমাত্রা ওই সময় নেমে যেতে পারে পাঁচ ডিগ্রিতেও, তখন তাদের প্রয়োজন হবে আশ্রয়, কম্বল আর গরম জামাকাপড়। গাজার বিপর্যয়ের মাত্রা এমনই যা আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থা (আনরোয়া) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ৯২ শতাংশ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি পরিবার ধ্বংসস্তূপ আর বোমাবিধ্বস্ত ভবনে বাস করছে যা আলোকচিত্র অথবা ভিডিওচিত্রে তুলে ধরা সম্ভব নয়, ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় টিকে থাকার সরঞ্জাম কিছুই নেই সেখানে নিশ্চিতভাবে।
দীর্ঘমেয়াদি ত্রাণকাজ নির্বিঘ্ন করা এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির পক্ষে কথা বলে চলেছে সেভ দ্য চিলড্রেন। এগুলোর উপায় বের করতে হবে। সেভ দ্য চিলড্রেন ইউকে’র প্রধান নির্বাহী মোয়াজ্জম মালিক সম্প্রতি মিশর সীমান্তের রাফায় ত্রাণ সরবরাহে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পন্থার আহ্বান জানিয়েছেন। সীমান্তের উভয় পাশে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় ধারাবাহিকভাবে ত্রাণ সরবরাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।
মিশর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাদের হাতে ত্রাণ রয়েছে, আমরা এজন্য প্রস্তুত। এসব ত্রাণের মধ্যে আরও রয়েছে ১০ হাজার হাইজিন কিট যাতে আছে সাবান, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট, স্যানিটারি প্যাড এবং জীবন রক্ষাকারী মেডিক্যাল আইটেম; আছে শেল্টার আর উইন্টার কিট এবং নগদ অর্থ সহায়তা। আমরা সেখানে প্রবেশের অনুমতি পেলে জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করব। শিশুদের কেবল মৌলিক মানবিক রসদই প্রয়োজন নয়, তাদের বিপুল পরিসরে অন্যান্য সেবারও প্রয়োজন।
শিশুদের ওপর এই দুই বছরের যুদ্ধের দীর্ঘকালীন প্রভাবের দিকেও আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। আশু ত্রাণ সহায়তার চেয়ে সেটা কম নয়। ২০২৪ সালে জাতিসংঘ উপসংহার করেছিল যে, শিশুর জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে মারাত্মক জায়গা হচ্ছে অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড।
অমানুষিক সহিংসতার প্রভাবে মানসিক আঘাত পাওয়া গাজার শিশুদের প্রয়োজন বিশেষায়িত মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা। সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশুবান্ধব গণমাধ্যমে এক শিশু লিখেছে : ‘আমি যদি বেহেশতে থাকতে পারতাম আমার মায়ের কাছে, বেহেশতে আছে ভালোবাসা, খাবার আর পানি।’
গাজার শিশুরা তৃতীয় বছরের মতো বিদ্যালয়ের বাইরে রয়েছে। এই সময়কাল বেড়েই চলেছে আর এতে তাদের লেখাপড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। গাজার সবখানে ত্রাণ সংস্থাগুলো সাময়িকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রগুলো ফের চালু করতে পারে সেখানকার ৭ লাখ শিশুর পড়াশোনার জন্য।
বিশ্বের যে কোনো স্থানের চেয়ে গাজায় অঙ্গ হারানো শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গত জানুয়ারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অঙ্গ হারিয়েছে ৮০০ শিশু। ২০২৪ সালে গাজায় বিস্ফোরক অস্ত্র ব্যবহারের পরিণতিতে দৈনিক গড়ে ১৫ জন শিশু এমনভাবে অঙ্গ হারিয়েছে যে, সারাজীবন তাদের পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। এসব শিশুর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি বিশেষজ্ঞ সহায়তা।
গাজা যুদ্ধ শুরুর সময় থেকে অকল্পনীয় সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে আমরা রাতদিন কাজ করছি গাজায় মানবসৃষ্ট সংকট মোকাবিলা করার জন্য। আমরা সেখানে ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন মানুষের কাছে জীবন রক্ষাকারী সহায়তা ও ত্রাণ সরবরাহ করেছি; যাদের অর্ধেকই শিশু।
মানবিক সহায়তা একটি অধিকার এবং এর বাধ্যবাধকতা রয়েছে; রাজনৈতিক দরকষাকষি এবং রাজনৈতিক বা সামরিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য এটি পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলে না। ত্রাণ হচ্ছে সহায়তার হাতিয়ার, নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র নয়। ইসরায়েলকে অবশ্যই অবিলম্বে সব সীমান্ত খুলে দিতে হবে। এমনকি যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হলেও এর কম কিছু হলে শিশুদের জীবন আর ভবিষ্যৎ ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যেই থেকে যাবে। এর কম কোনো কিছুই যথেষ্ট নয়।
অ্যালিসন গ্রিফিন : সেভ দ্য চিলড্রেন ইউকে’র কনফ্লিক্ট অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান ক্যাম্পেইন্স প্রধান। ১৮ অক্টোবর দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত তার নিবন্ধটি অনুবাদ করেছে আমাদের সময় ডেস্ক
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?