বেতন-ভাতা নিশ্চিত হোক

ড. কামরুজ্জামান
১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বেতন-ভাতা নিশ্চিত হোক

সারাদেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যৌক্তিক বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য বিষয়ে ন্যায়সঙ্গত দাবি নিয়ে আন্দোলন চলছে। দাবি আদায়ের আন্দোলনে শিক্ষকদের ওপর অমানবিক নির্যাতন ও অপমান সত্যিই দুঃখজনক এবং কষ্টদায়ক। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও মূল্যায়নে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা প্রয়োজন।

শিক্ষকদের দাবি খুব সামান্য। ২০% বাড়ি ভাড়া আর ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যে বেতন পান তা দিয়ে পরিবার নিয়ে কষ্ট করে চলেন। তারপরও শিক্ষকতার মতো একটি মহান পেশায় নিজেদের নিয়োজিত রাখছেন ভালো মানুষ গড়ার আশায়, জাতি গঠনের আশায়। শাসক শ্রেণি শিক্ষা নিয়ে কখনও ভাবেনি। ভাবলে শিক্ষকের সম্মান, মর্যাদা এবং সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা থাকত সবার ওপরে। অথচ দুর্ভাগ্য, ন্যূনতম দাবি আদায়ের জন্য শিক্ষকদের এ দেশে আন্দোলন করতে হয়। সে আন্দোলনে আবার শিক্ষকদের ওপর চলে অসম্মান ও নির্যাতন। এ দুঃখ রাখার আসলে জায়গা নেই।

আমরা পৃথিবীর বাইরের কোনো দেশের নয়। আমাদের দেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবচেয়ে কম বেতনে চাকরি করে আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজ। ভারত, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল ভুটানের মতো দেশেও আমাদের চেয়ে বেশি বেতন দেওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন স্যারের একটা লেখার তথ্যে বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে। যার অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করছি- ‘মালদ্বীপে একজন প্রাথমিকের শিক্ষক বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ লাখ টাকা বেতন পায় যা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সমান বেতন, ভারতে একজন প্রাথমিকের শিক্ষক পায় প্রায় বাংলাদেশি টাকায় ৫০ হাজার টাকা, নেপালে পায় বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫৫ হাজার টাকা, ভুটানে পায় প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি টাকা, শ্রীলংকায় পায় গড়ে বাংলাদেশি টাকায় ২৫ হাজার আর পাকিস্তানে পায় গড়ে ২৫ হাজার বাংলাদেশি টাকায়। আর আমার সোনার বাংলার প্রাথমিকের শিক্ষকরা পায় প্রায় ১২-১৪ হাজার টাকা। এই ৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি অথচ এই ৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম।

শিক্ষকদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে শারীরিকভাবে আঘাত করা, হেনস্তা করা এবং অসম্মান করা কোনো সভ্য কাজ হতে পারে না।

আমাদের দেশে বড় বড় দুর্নীতি হয়, বিদেশে টাকা পাচার হয়। ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে। জাতি গঠনে ঘুষ-দুর্নীতি যেমন নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, তেমনি শিক্ষার নৈতিক ও যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

একটা দেশের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব শুধু শিক্ষার সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে আমাদের দেশে শিক্ষার সঠিক উন্নয়নে টেকসই কারিকুলাম ও গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। যা হয়েছে তার প্রায় সবই হয়েছে সার্টিফিকেটনির্ভর শিক্ষা। আর যে জায়গায় সবচেয়ে বেশি অবহেলা করা হয়েছে তা হলো- শিক্ষকদের কম বেতন প্রদান এবং অবমূল্যায়ন। ভালো শিক্ষক পেতে হলে শিক্ষকতা পেশায় যোগ্যদের ধরে রাখতে হলে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

শিক্ষার যুগোপযোগী পরিবর্তন না করলে, মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন না হলে জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের বিশাল একটা জনসংখ্যা আছে। এখন কাজ হচ্ছে এই জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করা। আর এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সবার আগে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েই আজকে উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করেছে। আমাদের সমসাময়িক দেশ মালয়েশিয়া বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। তারা প্রথমে শিক্ষাকেই অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেশ জাপান আজ বিশ্বের প্রথম সারির উন্নত দেশ। জাপানের শিক্ষা ও প্রযুক্তি আজ বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডে, আয়ারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড কানাডা ইত্যাদি দেশ শুধু শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বে অর্থনৈতিক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানে এগিয়ে রয়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও আজ শিক্ষায় অনেক এগিয়ে।

একটি দেশ জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে না গেলে সে দেশ উন্নত দেশ হয় না। একটি দেশের শিক্ষার মানই বলে দেয় তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির মানদণ্ড। শিক্ষা যদি মানসম্মত শিক্ষা না হয় তাহলে সে শিক্ষা নিয়ে বেশিদূর এগিয়ে যাওয়া যায় না। আমাদের দেশের শিক্ষার মান ও মর্যাদা এখনও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। শিক্ষার মান ও মর্যাদা পরিবর্তন করা এখন সময়ের দাবি। এই কাজটি করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের জীবনমানের পরিবর্তন। প্রয়োজন উচ্চশিক্ষিত ও যোগ্য শিক্ষকদের মূল্যায়ন এবং বর্ধিত বেতন কাঠামো।

শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য শিক্ষকদের ন্যূনতম দাবি মেনে নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল প্রদান। শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হবে কেন? অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার উন্নয়ন ও শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে- শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন না হলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।


ড. কামরুজ্জামান : শিক্ষক, ও গবেষক