শিক্ষাঙ্গনে র‌্যাগিং বন্ধ হোক

আরিফুল ইসলাম রাফি
১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
শিক্ষাঙ্গনে র‌্যাগিং বন্ধ হোক

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিষবৃক্ষের মতো ছড়িয়ে আছে ‘র?্যাগিং’ নামের এক নোংরা প্রথা, যার শিকার হচ্ছেন নবীন শিক্ষার্থীরা। নবীনরা স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন, কিন্তু প্রথম পরিচয়েই পান অপমান, ভয়, আর মানসিক নিপীড়নের স্বাদ।

র?্যাগিংয়ের শিকড় খুঁজলে দেখা যায়, এটি নতুন কোনো প্রথা নয়। এর উৎপত্তি ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে, যেখানে নবাগতদের মানসিক দৃঢ়তা যাচাইয়ের নামে কিছু রসিকতা বা প্রহসন করা হতো। পরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তা ছড়িয়ে পড়ে ‘ওয়েলকাম কালচার’ হিসেবে। উদ্দেশ্য ছিল নতুনদের মেলামেশা শেখানো; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি বিকৃত রূপ নেয়। দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে, বিশেষ করে ভারতে ও পরে বাংলাদেশে র?্যাগিং হয়ে ওঠে আধিপত্য বিস্তারের এক অমানবিক প্রথা।

বাংলাদেশে র?্যাগিং প্রথম আলোচনায় আসে ৮০-র দশকে। তখন কিছু আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে নবীনদের ‘মজা করে ভয় দেখানো’ সংস্কৃতি ধীরে ধীরে পরিণত হয় শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক অবমাননার ঘটনায়। আজ সেই বিকৃত ধারাটি ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি, বেসরকারি, এমনকি পলিটেকনিক ও মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত।

র?্যাগিংয়ের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো এর বহুমাত্রিকতা। এটি কেবল ঠাট্টা বা অল্প কিছু নির্দেশ নয় বরং মানসিক সন্ত্রাসের এক চক্র। নবীন শিক্ষার্থীদের দিয়ে করানো হয় অশালীন কাজ, বাধ্য করা হয় অপমানজনক বক্তব্য দিতে, অনেক সময় রাতভর দাঁড়িয়ে থাকতে বা নির্দিষ্ট পোশাক পরতে। কোথাও কোথাও সিনিয়ররা নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য নবীনদের ‘শিক্ষা’ দিতে গিয়ে শারীরিক নির্যাতনের আশ্রয় নেন।

এর সঙ্গে যোগ হয় রাজনীতি। অনেক সময় ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় র?্যাগিং পরিচালিত হয় ‘শিক্ষা’ বা ‘নিয়ম-শৃঙ্খলা শেখানোর’ অজুহাতে। ফলে প্রশাসনও অনেক সময় নীরব থাকে। কারণ ক্ষমতার রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরমহলের গোড়া পর্যন্ত প্রবেশ করেছে।

২০২০ সালে ‘র‌্যাগিং’ নিষিদ্ধ করে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে র‌্যাগিংবিরোধী কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। তবে বাস্তবে এই নিষেধাজ্ঞা ও কমিটি গঠনের নির্দেশ কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনীতি বা আচরণবিধিতে র?্যাগিংবিরোধী ধারা থাকলেও তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয় না।

অন্যদিকে ভারতে অ্যান্টি র?্যাগিং আইন ২০১১ অনুযায়ী, যে কেউ র?্যাগিংয়ের সঙ্গে জড়িত, তাকে দোষী সাব্যস্ত হলে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। বাংলাদেশেও এমন আইন থাকা উচিত, যেখানে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত থাকবে র?্যাগিংয়ের ধরন, শাস্তির পরিমাণ ও ভুক্তভোগীর সুরক্ষা ব্যবস্থা।

মিডিয়া র?্যাগিংয়ের অনেক ঘটনা প্রকাশ করলেও তা অনেক সময় স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে না। কারণ প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্তে বিলম্ব করে বা ‘সমঝোতার’ মাধ্যমে ঘটনা গোপন রাখে।

র?্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজন ভুক্তভোগীদের মানসিক পুনর্বাসন। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করা যেতে পারে ‘কাউন্সেলিং সেন্টার’, যেখানে শিক্ষার্থীরা গোপনে সাহায্য নিতে পারবেন। একই সঙ্গে তৈরি করা যেতে পারে ‘অ্যান্টি র?্যাগিং সেল’, যেখানে থাকবে শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব।

অভিযোগ পাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করা এবং ফলাফল প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

র?্যাগিং অমানবিক সংস্কৃতি, যা শিক্ষাকে কলুষিত করছে, মানবিক সম্পর্ককে ভেঙে দিচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভয় নয়, ভালোবাসা ও সম্মানের পরিবেশই হোক প্রধান ভিত্তি। বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি স্থান হওয়া উচিত যেখানে নবীনরা প্রথম দিনেই অনুভব করবে তারা নিরাপদ, তারা গুরুত্বপূর্ণ, তারা একজন মানুষ হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ।


আরিফুল ইসলাম রাফি : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত লেখকের নিজস্ব