এইচএসসির ফলকে ‘বিপর্যয়’ বলা যায়?

আনোয়ার হোসেন
১৭ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
এইচএসসির ফলকে ‘বিপর্যয়’ বলা যায়?

গতকাল ১৬ অক্টোবর ২০২৫-এ প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, দেশের ৯টি সাধারণ ও কারিগরি এবং মাদ্রাসা বোর্ড মিলিয়ে ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩। ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮। সেই হিসাবে এবার পাসের হার কমেছে ১৮ দশমিক ৯৫। এদিক এ বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, এবার পাসের হারে সবচেয়ে এগিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। এ বোর্ডে পাসের হার ৭৫ দশমিক ৬১। অন্য বোর্ডগুলোর মধ্যে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৬৪ দশমিক ৬২, কুমিল্লা বোর্ডে ৪৮ দশমিক ৮৬, রাজশাহীতে ৫৯ দশমিক ৪০, যশোর ৫০ দশমিক ২০, চট্টগ্রামে ৫২ দশমিক ৫৭, বরিশালে ৬২ দশমিক ৫৭, সিলেটে ৫১ দশমিক ৮৬, দিনাজপুরে ৫৭ দশমিক ৪৯, ময়মনসিংহে ৫১ দশমিক ৫৪ এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এদিকে ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সারা দেশে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন। গত বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। সেই হিসাবে এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন। তবে এবারের পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ২০২৫ সালে দেশের ২০২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন। মোট ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন; যা মোট পরীক্ষার্থীর ৪১ দশমিক ১৭ শতাংশ।

এটি কেবল একটি পর্ব, সামনে আরও নানা সুযোগ প্রতীক্ষা করছে। ‘মনে রাখতে হবে, ভুবনে কোনো অর্জনে বা অসফলতায় অতি আবেগপ্রবণ হওয়া সমীচীন হবে না। বড় বিজয়ের দিকে দৃষ্টি স্থির রাখতে হবে।

এইচএসসি, আলিম ও অনুরূপ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বলছিÑ আপনি একা অসফল নন, অনুরূপ ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ জন শিক্ষার্থী এই যাত্রায় অকৃতকার্য হয়েছেন। এ অকৃতকার্যদের মধ্যকার অনেকেই হয়তো আগামী দিনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবেন। তবে হতে হবে অধ্যবসায়ী। যেমন ধরুন, আব্রাহাম লিঙ্কনÑ জীবনে অনেকবার পরাজিত হওয়ার পরও তিনি অধ্যবসায়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এপিজে আবদুল কালাম প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি ভারতের বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। শ্রীনিবাস রামানুজনÑ তিনি গভীর অধ্যবসায় ও সাধনার মাধ্যমে গণিতে অসাধারণ অবদান রাখেন। জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্ল চন্দ্র রায়Ñ তাদের মতো বিজ্ঞানীরাও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজেদের জীবনে সাফল্য এনেছেন। তবে একজন ছাত্র বারবার চেষ্টা করে পরীক্ষায় ভালো ফল কেন করতে পারবেন না?

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জিপিএ-৫ প্রাপ্তি ভর্তি পরীক্ষায় কিছুটা এগিয়ে রাখলেও বাস্তবে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে জিপিএ-৫ না পেয়েও পরবর্তীকালে উচ্চমানে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন অনেকেই। তাই পরবর্তী ধাপে সফলতার জন্য স্বপ্ন, সাহস, বিশ্বাস, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমই মুখ্য। প্রকৃতপক্ষে ভালো পরীক্ষা দেওয়ার পরও প্রযুক্তিগতসহ মানবীয় যে কোনো ভুলে ফলাফল বিপর্যয় হতে পারে, যা আকাশ থেকে পড়ার মতো কিছু নয়, কারণ ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণের সুযোগ রয়েছে।

ছাত্রছাত্রীদের উচিত শিক্ষকদের অধিক সম্মান করা, কারণ শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, চরিত্র এবং মূল্যবোধ তৈরিতে সাহায্য করেন, যা তাদের সারাজীবনে প্রভাব ফেলে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন, তাদের সম্মান করা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। শিক্ষকদের প্রতি সম্মান দেখালে ছাত্র এবং শিক্ষক উভয়ের মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা শেখার প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করে তোলে। শ্রেণিকক্ষে একটি ইতিবাচক এবং সহযোগিতামূলক মনোভাব বজায় রাখা উচিত। শিক্ষকদের প্রতি ধৈর্য এবং সহানুভূতি প্রদর্শন করা উচিত, কারণ তাদের নিজস্ব চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য এক্সট্রা কারিকুলাম বা সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমে (ঊঈঅ) যুক্ত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের সার্বিক বিকাশ, সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এটি শিক্ষার্থীদের পেশাগত জীবনেও সুবিধা দেয় এবং উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করার ক্ষেত্রে একটি বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে : খেলাধুলা (যেমনÑ ফুটবল, ক্রিকেট), বিতর্ক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড (যেমনÑ গান, নাটক), স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক ক্লাব।

ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতর্ক ও লেখালেখিতে যুক্ত হওয়া জরুরি, কারণ এতে যুক্তিতর্ক ও যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং একটি সুসংগঠিত বক্তব্য তৈরির ক্ষমতা অর্জিত হয়। এটি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা করতে এবং নিজেদের মতামত কার্যকরভাবে প্রকাশ করতে সাহায্য করে।

এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষায় সফল নবীনরা আগামী দিনে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করবেন। তরুণ প্রজন্ম সর্বদিক থেকে সচেতন হয়ে উঠবেন। একদিন আপনাদের নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। একমাত্র পড়াশোনা করলে হবে না, নবীন শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পরিশেষে সর্বজনীনভাবে প্রীতি ও মঙ্গলকামনা করে এ নিবন্ধের সমাপ্তি টানছি।


ড. মো. আনোয়ার হোসেন : প্রাবন্ধিক ও প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল


মতামত লেখকের নিজস্ব