বেকারত্ব তরুণ প্রজন্মের নীরব যন্ত্রণা

ইকবাল মাহমুদ
১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বেকারত্ব তরুণ প্রজন্মের নীরব যন্ত্রণা


আমাদের দেশে দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সে অনুপাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে না। আজকের তরুণ প্রজন্ম শিক্ষা শেষ করেও চাকরির সুযোগ পাচ্ছে না, দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তারা হচ্ছে হতাশ, দিশেহারা। তারা সমাজে নীরব কান্নার যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছে।

আমরা একটি ছোট আয়তনের দেশে বাস করি, কিন্তু এই ছোট্ট ভূখণ্ডে বেকারত্বের জাল আজ এতটাই বিস্তৃত যে, লাখ লাখ মানুষ তার বেড়াজালে বন্দি। এই বন্দিশালায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট ভোগ করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর স্বশিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েরা। তারা স্বপ্ন দেখেছে, অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে ভালো ফলাফলের জন্য, শুধু একটা আশার আলো পাওয়ার জন্য। অথচ বারবার চাকরির বাজারে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর তাদের মনের গভীরে যে হতাশার মেঘ জমে, তা শুধু তারাই অনুভব করতে পারে। এই নীরব যন্ত্রণার প্রকাশ নেই, কারণ সমাজ তাদের কাঁধে হাত রেখে অনুপ্রেরণা দেওয়ার বদলে ছুড়ে দেয় কটূক্তির তীর। ‘কিছু একটা তো করতে পারতিস’, ‘তোর দ্বারা কিছু হবে না,’ এই ধরনের মন্তব্যগুলো তীরের মতো বিঁধে, যা তাদের আত্মবিশ্বাসকে তিলে তিলে ক্ষয় করে দেয়।

যখন এই হতাশা আর গ্লানি চরমে পৌঁছায়, তখন অনেকেই বাধ্য হয় দেশ ছাড়তে, পরিবারের মায়া বিসর্জন দিতে। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে তারা পাড়ি জমায় দূর প্রবাসে, কেবল একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশায়। সেখানেও তাদের সংগ্রাম শেষ হয় না। দালালদের বঞ্চনা, প্রতিকূল পরিবেশ আর একাকিত্বের যন্ত্রণায় অনেকেই হয়ে ওঠে দিশাহারা পথিক। আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপরও একটা প্রশ্ন। কেন একজন সক্ষম, শিক্ষিত যুবককে তার জন্মভূমি ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ছুটতে হয়? এই গভীর সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু সরকার বা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে আঙুল তুললে হবে না। প্রয়োজন আমাদের প্রত্যেকের সচেতনতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বেকারত্ব কোনো অলসতা বা অযোগ্যতার ফল নয়; এটি মূলত বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যকার গভীর ফারাকের ফল।

আমাদের তরুণ সমাজকে বুঝতে হবে, সরকারি চাকরির পিছে দৌড়ানোই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এখন দরকার দক্ষ মানবসম্পদ। নবীনদের এখনই উচিত গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে গিয়ে নিজেদের বিশেষ দক্ষতা অর্জন করা। যে জ্ঞান বা যোগ্যতা বাজারে সরাসরি কাজের সুযোগ তৈরি করে, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর যুগে কোডিং, ডেটা অ্যানালিটিক্স, ডিজিটাল মার্কেটিং বা বিভিন্ন কারিগরি ও পেশাদার দক্ষতা অর্জন করা সময়ের দাবি।

একই সঙ্গে আমাদের সমাজের পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কোনো পেশাকে ছোট করে দেখা চলবে না। একজন দক্ষ কাঠমিস্ত্রি, একজন ভালো ইলেকট্রিশিয়ান, একজন সফল ফ্রিল্যান্সার বা একজন উদ্যোগী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, তারা প্রত্যেকেই সমাজের মূল্যবান অংশ। যখন আমরা কায়িক শ্রম বা কারিগরি দক্ষতাকে সম্মানের চোখে দেখব, তখনই বহু তরুণ চাকরির পেছনে না ছুটে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার দিকে এগোবে। আত্মনির্ভরশীলতাই বেকারত্বের জাল ছিন্ন করার মূলমন্ত্র। নিজের মেধা, যোগ্যতা ও সামান্য পুঁজিকে কাজে লাগিয়ে ছোট পরিসরে কিছু শুরু করার সাহস দেখাতে হবে।

বেকারত্বের এই বোবাকান্না একদিন থামবেই, যদি আমরা সম্মিলিতভাবে উদ্যোগী হই। সমাজকে হতে হবে সহানুভূতিশীল, কটূক্তির বদলে দিতে হবে প্রেরণা ও সাহস। সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করতে হবে এমন সুযোগ, যেখানে নবীনরা দক্ষতা অর্জন করতে পারবে এবং সেই দক্ষতাকে কাজে লাগানোর প্ল্যাটফর্ম পাবে।

তরুণরা দেশের শক্তি, তাদের সম্ভাবনাই আগামী বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার চালিকাশক্তি। তাই বেকারত্বের এই বেড়াজাল ভেঙে, প্রত্যেক তরুণকে তার যোগ্যতার আলোয় উজ্জ্বল হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সেজন্য নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা খুবই জরুরি।

মনে রাখতে হবে, বেকারত্ব একটি দেশের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। এটি শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি সামাজিক অস্থিরতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যে সমাজে শিক্ষিত যুবকের হাতে কাজ থাকে না, সেই সমাজে হতাশা আর অপরাধপ্রবণতা বাড়ে।

আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি কর্মমুখর, সম্মানজনক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। এমন একটি সমাজ, যেখানে থাকবে না বেকারত্বের গ্লানি, থাকবে শুধু স্বপ্ন ও সম্ভাবনার জয়গান। আমাদের তরুণ প্রজন্মই দেশের ভবিষ্যৎ; তাদের ভেলা যেন ঝড়ের কবলে না পড়ে, সেদিকে নজর দেওয়া আমাদের জাতীয় কর্তব্য। এই নীরব কান্নাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করার এখনই সময়।


ইকবাল মাহমুদ : শিক্ষার্থী, ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ