বারুদের স্তূপের ওপর বিহারের বিধানসভা নির্বাচন

মোহাম্মদ সাদউদ্দিন
১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বারুদের স্তূপের ওপর বিহারের বিধানসভা নির্বাচন


ভারতের পূর্বাংশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী বিহারে ৬ ও ১১ নভেম্বর দুই দফায় ভোট হবে। ভোটের ফল প্রকাশিত হবে ১৪ নভেম্বর। এই ঘোষণা এমন এক সময়ে নির্বাচন কমিশন করেছে, যখন নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে পর পর শুনানি এসআইআর সংক্রান্ত মামলা নিয়ে। সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ৯ নভেম্বর বলেই দিয়েছেন, যাদের নাম ভোটার লিস্ট থেকে বাদ যাবে তাদের বিনা পয়সায় আইনি সহায়তা দেওয়া হবে। আর এখানেই একটা বিষয় পরিষ্কার, ভারতের বিচারব্যবস্থা অনেকটাই মানুষের কাছে একমাত্র ভরসার জায়গা। যদিও এখন ভারতের বিজেপি সরকার বিচারব্যবস্থাকে নিজের মতো ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে রায়ে তা দেখা গেছে। কিন্তু এখন এসআইআর নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে নির্বাচন কমিশনকে চেপে ধরেছেন তার কাজকর্ম নিয়ে, তাতে নির্বাচন কমিশন সিবিআই-ইডির মতো রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। একেবারেই যেন ‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে যাওয়া’র মতো। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা এটাই মনে করছেন।

বিহারে প্রথম পর্যায়ে যে বিশেষ নিবিড় সংশোধনী (এসআইআর) করা হয়েছে, তাতে ৭.২৪ কোটি ভোটারের মধ্যে ৬৬ লাখ বাদ গেছেন। এটা প্রথম দফায়। বেশির ভাগ প্রান্তিক মানুষ। তাদের একটা অংশকে দেখানো হয়েছে যে, তারা নাকি মৃত। কিন্তু এই ভোটাররা সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তারা মৃত নন। তারা জীবিত। নির্বাচন কমিশন যে কতখানি ফাঁকি মেরেছে তা প্রমাণিত আদালতের কাছেই। প্রাথমিক সংঘাতটা খুব স্পষ্ট আদালত ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যেই। এখনও সংঘাত আরও বাকি। বিহারের যে ৬৬ লাখ ভোটার বাদ পড়ে গেলেন তাদের বেশির ভাগই কিন্তু ধর্মীয়ভাবে মুসলিম, ক্ষেতমজুর, শ্রমিক, আদিবাসী, দলিত, নিম্নবর্গের হিন্দু। এই প্রান্তিক মানুষরা ভোটের দিন ঘোষণা হওয়া সত্ত্বেও আদালতের কাছে ভরসা পেয়ে একদিকে আইনি লড়াই করছেন, তেমনি তারা আজ পথে। ক্রমেই বিহারে আন্দোলনের পারদ এখন ঊর্ধ্বমুখী। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু কোনো বিষয়ের ওপর যখন মামলা চলে অর্থাৎ সাবজুডিস বিষয় নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পূর্ববৎ বিষয়গুলো বহাল রাখতে হবে। অর্থাৎ পুরনো ভোটার লিস্ট অনুসারে ভোট নিতে হবে। একদিকে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে মামলা, এসআইআরবিরোধী আন্দোলন, অন্যদিকে পুরনো ভোটার লিস্ট অনুসারে ভোট প্রদান, মোটকথা বিহার এখন বারুদের স্তূপের ওপর। গত ২০ সেপ্টেম্বর পাটনায় রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে যে সমাবেশ হয় এই এসআইআরকে কেন্দ্র করে, তা তো বলা যায় জনসমুদ্র। তার রেশ আবার দেখা যাচ্ছে। আন্দোলনের পারদ ঊর্ধ্বমুখী।

ভারতের সংবিধান নিয়ে এ ব্যাপারে আলোচনা করা দরকার বলে মনে করছি। ভারতের সংবিধানে খুব স্পষ্ট, দেশের নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সব সাবালক-সাবালিকা নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করা। এ জন্য ভারতীয় সংবিধানের ৩২৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ধর্ম, জাতি, বর্ণ বা লিঙ্গের কারণে কোনো ব্যক্তিবিশেষ ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য বা অন্তর্ভুক্তির দাবি? করার জন্য অযোগ্য হবেন না। সেই ভাবনা অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিত্ব আইন (১৯৫০)-এর ১৬ ও ১৮ নম্বর ধারায় বলা আছে, প্রত্যেক ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে ভারতীয় নাগরিক (যিনি মানসিক অসুস্থ নন বা সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী নন) নির্বাচনে মতদানের জন্য ভোটার তালিকায় নাম তোলার অধিকারী। লক্ষ করার বিষয়, কোনো ক্ষেত্রেই ভোটার হওয়ার যোগ্যতা বা মানদণ্ডের কথা বলা নেই। ভোটার তালিকায় নাম তুলতে গেলে সাবালক-সাবালিকা নাগরিককে ভোটার নিবন্ধন (১৯৬০) বিধি অনুযায়ী ৬ নম্বর ফরমের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে এবং তাতে ভারতীয় নাগরিক বলে ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু ফরমের কোথাও নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে কোনো নথি দাখিল করার কথা বলা হয়নি। যদিও এই ফরমটি ২০১৬ সালে পরিমার্জন করা হয়েছে বিজেপির আমলেই।

আইনের কোথাও বলা হয়নি যে, ভোটার তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও ভোটারকে নাম বজায় রাখার জন্য আবার আবেদন করতে হবে। অথচ নির্বাচন কমিশন ২৪ জুনের (২০২৫) নির্দেশিকায় প্রত্যেক ভোটারকে নতুন করে ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য আবেদন করতে হুকুম জারি করেছে। আর নিজেদের ইচ্ছামতো একটি আবেদনপত্র তৈরি করেছে। কিন্তু আইনে কোথাও বলা হয়নি ভোটারকে ভোটার তালিকায় নাম বজায় রাখার জন্ম নতুন করে আবেদন করতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ১১টি প্রমাণ দিতে হবে যেখানে প্রমাণপত্র হিসেবে আধার কার্ড, প্যান কার্ড, জব কার্ড, রেশন কার্ড রাখা হয়নি। তার বদলে রয়েছে পেনশনের আদেশপত্র, জমির দলিলসহ আরও বিদঘুটে প্রমাণপত্র, যা প্রান্তিক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ভারতের একটা বড় অংশের মানুষ ভূমিহীন। প্রান্তিক মানুষরা তো প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার। ইতোমধ্যে বিহারে নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গা জঙ্গি হিসেবে আরও তিন লাখ ভোটারকে নোটিশ পাঠিয়েছে। প্রাথমিক খসড়ায় যে ৬৫ লাখ ভোটারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গেছে, তাদের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বা রোহিঙ্গা জঙ্গি পাওয়া যায়নি। নোটিশগুলো হয়েছে বিহারের মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব ও পশ্চিম চম্পারন, মধুবনি, কিষাণগঞ্জ, পুর্ণিয়া কাটিহার ও সুপল জেলায়। দশ পুরুষ ধরে বসবাসকারীদের ভাগ্যে এখন অনুপ্রবেশের নোটিশ।

পশ্চিমবঙ্গে দিল্লি থেকে নির্বাচন কমিশনের টিম এসেছিল কলকাতায়। এখানেও বিভিন্ন দল নির্বাচন কমিশনের অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখায়। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর করতে গেলে আগুন জ্বলবে। পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর হবেই তা কিন্তু স্পষ্ট হয়েছে? নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিদের বৈঠক থেকেই। এখানেও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ও? রোহিঙ্গা জঙ্গি হিসেবে প্রায় দুই কোটি ভোটার বাদ যাবেন। তবে যেহেতু বিহারের ক্ষেত্রে আদালতের চাপে রয়েছে, এখানেও ঠিক তাই হবে। অজস্র মামলা হবে। রাস্তার দখল নেবে প্রান্তিক মানুষ। বিহারের বিধানসভার পর ২০২৬-এ পশ্চিমবঙ্গ ও আসামসহ আরও কয়েকটি রাজ্যে পর পর নির্বাচন। সেখানেও সমুচিত শিক্ষা পাবে বিজেপি। বিহারে নীতীশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড)-বিজেপি জোট এমনিতেই ব্যাকফুটে। ওয়াক্্ফ আইন সমর্থন করায় নীতীশ কুমারের কাছ থেকে তার দলের মুসলিম নেতারা বেরিয়ে গেছেন। ৯ শতাংশ মুসলিম ভোটও বেরিয়ে গেছে। তা এখন ইন্ডিয়া জোটে। মানুষ তার ভোটাধিকার হারার ভয়ে এমনিতেই তুষের আগুনের মতো জ্বলছে। এই প্রান্তিক মানুষরা এখন কার্যত বারুদ।


মোহাম্মদ সাদউদ্দিন : কলকাতার কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও কবি


মতামত লেখকের নিজস্ব