কথা হোক মানসিক শান্তি নিয়ে
প্রতিনিয়ত নারীর নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের উদ্বেগ ও আলোচনা অন্তহীন। রাস্তাঘাটে, কর্মক্ষেত্রে, এমনকি নিজের ঘরেও নারী কতটা সুরক্ষিত, সেই প্রশ্ন আমাদের তাড়া করে ফেরে। নারী সুরক্ষার জন্য আইন হচ্ছে, বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে, সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু এই সবকিছুর আড়ালে একটি বিষয় প্রায়ই চাপা পড়ে যায়, তা হলো নারীর মানসিক শান্তি। শারীরিক নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে রাখতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই যে, নারীর মনোজগতে যে নিরন্তর রক্তক্ষরণ হয়, তার কোনো আইনগত সমাধান সহজে মেলে না। এখন সময় এসেছে, শুধু নারীর নিরাপত্তার গণ্ডি পেরিয়ে তার মানসিক শান্তির অন্বেষণে মনোযোগ দেওয়ার।
নিরাপত্তার অদৃশ্য খাঁচা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষয়
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন নারীর বেড়ে ওঠা মানেই অসংখ্য ‘না’-এর সঙ্গে পরিচিত হওয়া। ‘সন্ধ্যায় বাইরে যেও না,’ ‘একা কোথাও যাবে না,’ ‘কী পোশাক পরেছ খেয়াল রাখো,’ ‘ছেলেদের সঙ্গে বেশি মিশবে না’- এই প্রতিটি বাক্যই যেন নিরাপত্তার নামে এক একটি অদৃশ্য শিকল, যা তার স্বাধীনতার পায়ে পরিয়ে দেওয়া হয়। এই পড়ংঃধহঃব নজরদারি, ভয় আর আশঙ্কার পরিবেশে বেড়ে ওঠা একজন নারীর মানসিক স্বাস্থ্য কতটা বিপর্যস্ত হতে পারে, তা আমরা ভেবে দেখি না।
প্রতিদিন খবরের কাগজে নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র দেখতে দেখতে এবং নিজেদের জীবনে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হতে নারীদের মনে এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ (পযৎড়হরপ ধহীরবঃু) ও ট্রমা তৈরি হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, দেশে নারী ও কন্যাশিশুরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই নিরাপত্তাহীনতা কেবল শারীরিক আক্রমণের ভয় নয়, বরং এটি এক ধরনের মানসিক চাপ যা তাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা কেড়ে নেয়। এর ফলে তৈরি হয় বিষণ্নতা, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (চঞঝউ) এবং নানা ধরনের মনোদৈহিক সমস্যা।
শুধু সহিংসতা নয়, মানসিক চাপের বহুমাত্রিক রূপ
নারীর মানসিক অশান্তির কারণ কেবল যৌন হয়রানি বা শারীরিক নির্যাতন নয়। পরিবার ও সমাজে তার প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, সেটাও এর জন্য দায়ী। শিশুকাল থেকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের কম গুরুত্ব দেওয়া, তাদের স্বপ্ন বা ইচ্ছাকে অবদমিত করা এবং বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির অবহেলা ও মানসিক নির্যাতন- এসবই নারীর মনকে ক্ষতবিক্ষত করে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
কর্মক্ষেত্রে নারীকে প্রতিনিয়ত নিজের যোগ্যতা প্রমাণের লড়াই করতে হয়। সেখানেও লিঙ্গবৈষম্য, সহকর্মীদের তির্যক মন্তব্য এবং পদোন্নতিতে বাধা তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। ঘরে-বাইরে এই দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে গিয়ে এবং সবদিকে ‘ভালো’ থাকার সামাজিক চাপ নারীকে মানসিকভাবে নিঃশেষ করে দেয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে, নারীদের আত্মত্যাগ এবং সহনশীলতার গুণগান করা হলেও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তাকে বরাবরই উপেক্ষা করা হয়।
মানসিক শান্তি কেন জরুরি?
একজন মানসিকভাবে সুস্থ নারী একটি সুস্থ পরিবারের ভিত্তি। যখন একজন নারী মানসিকভাবে শান্তিতে থাকেন, তখন তিনি নিজের যত্ন নিতে পারেন, পরিবারকে সময় দিতে পারেন এবং নিজের স্বপ্নপূরণে মনোযোগী হতে পারেন। মানসিক শান্তি নারীর সৃজনশীলতা, কর্মদক্ষতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। যে সমাজে নারীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, সেই সমাজ কখনও সামগ্রিকভাবে উন্নতি করতে পারে না।
শারীরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিঃসন্দেহে জরুরি, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। একজন নারীকে সিসিটিভি ক্যামেরা বা আইন দিয়ে ঘিরে রাখা যেতে পারে, কিন্তু তার মনের ভেতরের ভয়, অপমান আর অস্থিরতাকে দূর করা না গেলে সেই নিরাপত্তা অর্থহীন। তাই আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর মানসিক স্বাস্থ্যকে নিয়ে আসতে হবে।
কীভাবে মিলবে মানসিক শান্তি
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
নারীর মানসিক শান্তির জন্য একটি সামগ্রিক পরিবর্তন প্রয়োজন। এর জন্য কয়েকটি দিকে নজর দেওয়া জরুরি :
পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : শৈশব থেকেই ছেলে ও মেয়েকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বড় করতে হবে। মেয়েদের আত্মবিশ্বাসী এবং স্বাবলম্বী হতে শেখাতে হবে, ভয় পেতে নয়। পরিবারে তাদের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে।
সহানুভূতিশীল পরিবেশ তৈরি : কর্মক্ষেত্রে এবং জনসমক্ষে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। নারীকে তার আবেগ প্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে এবং তার মানসিক অবস্থাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা : মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে সামাজিক ট্যাবু রয়েছে, তা ভাঙতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নারীদের জন্য কাউন্সেলিং এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে হবে।
আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূরীকরণ : নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানির বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি নারীর মনে নিরাপত্তাহীনতা ও হতাশা বাড়ায়, যা দূর করা অপরিহার্য।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি : অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে নারী নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, যা তার মানসিক শক্তি ও শান্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক।
নারীর নিরাপত্তা একটি বহিরাবরণ মাত্র, যার গভীরে রয়েছে তার মানসিক শান্তির আকুতি। আমরা যদি কেবল বাইরের সুরক্ষা নিয়েই ব্যস্ত থাকি এবং ভেতরের ক্ষতকে উপেক্ষা করি, তবে আমাদের সব আয়োজনই ব্যর্থ হবে। আসুন, আমরা এমন একটি সমাজ গড়ি যেখানে নারী শুধু শারীরিকভাবে নিরাপদ নয়, মানসিকভাবেও শান্তিতে, নির্ভয়ে এবং স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে। কেবল নারীর নিরাপত্তা নয়, তার মানসিক শান্তিও হোক আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
হেনা শিকদার : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, দর্শন বিভাগ