চাকসু হয়ে উঠুক শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর
বিগত নানা সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখনই কোনো সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তখনই ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, মাঝে মাঝে এটি বন্ধেরও দাবি ওঠে। আবার অন্যপক্ষে প্রশ্ন ওঠে- ছাত্ররাজনীতি না থাকলে অন্যায়ের প্রতিবাদ বা ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন হবে কীভাবে? ছাত্ররা যদি রাজনীতিবিমুখ হয়, তাহলে ভবিষ্যতে যোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া দুরূহ হবে। যদিও আমাদের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন বা অধ্যাদেশ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে তেমন কিছু বলা নেই। কিন্তু ছাত্র সংসদ গঠনের কথা আছে। প্রায় প্রতিটি আইনে শিক্ষক রাজনীতির বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও দলীয় সম্পৃক্ততার কথা বলা নেই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠন ও নানা রঙের আড়ালে শিক্ষকদের সমিতি বা সংগঠন রয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব শিক্ষক সমিতি ও ছাত্র সংগঠন দলীয় রাজনীতির শক্তিকে পুঁজি করে দলাদলি ও নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে যুক্ত। তবে ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দুর্বৃত্তায়ন ও হানাহানিমুক্ত করার কার্যকর উপায় হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদকে সচল করার মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করা। যদিও সেটাও দীর্ঘদিন আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কার্যকর ছিল না।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি ওঠে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও সেসব নির্বাচন নিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে নানা আলোচনা-বিতর্কও হয়েছে, হচ্ছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়াটাই আমাদের আশাবাদী করে, আশার আলো দেখায়।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারাবাহিকতায় প্রায় ৩৫ বছর পর আগামী ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন। আজ থেকে প্রায় ৫৯ বছর আগে চট্টগ্রামের অদূরে পাহাড়ঘেরা নিরিবিলি জোবরা গ্রামের পাশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নামে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু, তা আজ এক বিশাল মহীরুহ! ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম চাকসু নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে। প্রতি শিক্ষাবর্ষে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। তথ্যসূত্র মতে, এখন পর্যন্ত মাত্র ৬ বার নির্বাচনের আয়োজন করতে পেরেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর অনুষ্ঠিতব্য চাকসু নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসজুড়ে সবার মাঝেই আলাদা একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন পদের প্রার্থীরা বিগত কয়েকদিনের প্রচারে নানা প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছেন। ভোটাররা (শিক্ষার্থী) বলছেন, নির্বাচিত প্রার্থীরা সব প্রতিশ্রুতি হয়তো একবারেই পূরণ করতে পারবেন না, কিন্তু নিয়মিত চাকসু নির্বাচন হলে ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগবে নিঃসন্দেহে।
চাকসু নির্বাচনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা- শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করে ও ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন যেসব প্রার্থী, তারাই যেন নির্বাচিত হন। তারা এমন প্রার্থী চান, যারা রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করতে সক্ষম। তাদের প্রত্যাশা হলো, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যেন সৎ, সাহসী এবং শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর যৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হতে পারেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিপীড়নমূলক গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতির অনেকটাই অবসান হয়েছে। হল দখল ও আধিপত্যের রাজনীতিও এখন তেমন শোনা যায় না। কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচিতে যাওয়াও এখন আর শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যাকে কেন্দ্র করে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি সাজানোর চেষ্টা করছে। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরও এই পরিবর্তনগুলো টেকসই রূপ পাবে, ছাত্ররাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরবে, আসবে গুণগত পরিবর্তন, শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষিত হবে, ক্যাম্পাস হবে নারীবান্ধব- এসবই এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট সবার প্রত্যাশা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন শুধু নিছক ভোট বা স্লোগান কাঁপানো মিছিল নয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও তা পরিচালনা করা একটা প্রক্রিয়া ও অনুশীলনও বটে, এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ যোগ্য জাতীয় নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে পারে। এটা শিক্ষার্থীদের শিক্ষারই অংশ। এই অভিজ্ঞতা একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের পুঁজি। ছাত্র সংসদের (হল ও বিভাগ) নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিভার আত্মপ্রকাশ ঘটে। সক্রিয় ছাত্র সংসদ একজন শিক্ষার্থীর জীবনদর্শনও বদলে দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও নাগরিক হিসেবে আমাদেরও প্রত্যাশা, চাকসু নির্বাচন হোক অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক। সব শিক্ষার্থী (ভোটার) যেন নির্ভয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। কোনো ধরনের অনিয়ম বা প্রভাব খাটানো ছাড়া গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন করা গেলে সেটা হবে শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল সব ছাত্র সংগঠনসহ নির্বাচনে দাঁড়ানো প্রার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় সাফল্য। আমরা চাই, আমাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যারা নির্বাচিত হবেন, তারা সত্যিকার অর্থেই শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করবেন। আমরা চাই যারা নির্বাচিত হবেন, তারা দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেবেন। ক্যাম্পাসের মৌলিক সমস্যা, যেমন যাতায়াতের শাটল ট্রেন, শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট, লাইব্রেরি ও গবেষণা সুবিধার ঘাটতি এবং ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার অভাব- এসব সমাধানে আন্তরিকভাবেই কাজ করবেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে মনোযোগী হবেন। প্রতিদ্বন্দ্বী সব ছাত্র সংগঠন এবং প্রার্থীই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ক্যাম্পাসকে শিক্ষাবান্ধব করা এবং শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দিয়েছেন। আমাদের প্রত্যাশা, জাতীয় রাজনীতির মতো নির্বাচিত হওয়ার পর প্রার্থীরা যেন নিজেদের ইশতেহার নিজেরাই ভুলে না যান।
বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় গবেষণার প্রজননক্ষেত্র। গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি, উদ্ভাবনী চিন্তা-চেতনার বিকাশ প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য আধুনিক বিশ্বের জন্য সময়োপযোগী জ্ঞান ও গবেষণাধর্মী শিক্ষার বাতাবরণ তৈরি করা। আর সেই বাতাবরণ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে অভিভাবক হিসেবে শিক্ষক সমাজ আর তা বিকশিত হয় শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চায়, যা তাদের মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে গিয়ে একটি আলোকিত সমাজ ও উন্নত রাষ্ট্র গড়তে সহায়তা করে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের জরাগ্রস্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকটাই প্রাণহীন খোলসের মতো! যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনেকের মাঝেই পরমতসহিষ্ণুতা আর আদর্শের অনটন। এগুলোর জন্য চরমভাবে রাজনৈতিক বিভাজিত সমাজ অনেকটা দায়ী বলেই আমাদের মনে হয়।
ছাত্র সংসদগুলো যদি নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব পেত, তবে তা বিশ্ববিদ্যালয় ছাপিয়ে রাষ্ট্রকেও সুন্দর ও আলোকিত জ্ঞাননির্ভর নাগরিক সমাজ উপহার দিতে পারত বলেই আমাদের বিশ্বাস। যোগ্য ও আলোকিত নেতৃত্ব পেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা সত্যিকারের জ্ঞান ও গবেষণানির্ভর প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে, যা দেশ ছাপিয়ে বিশ্বের বুকে আরও উজ্জ্বল করবে বিশ্ববিদ্যালয়কে, এই বিশ্বাস আমাদের আছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা আশাবাদী, এমন যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচিত করে বর্তমান শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবেন। মনে রাখতে হবে, একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রধান চ্যালেঞ্জ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি এই চ্যালেঞ্জ সততা ও সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেশবাসীও তাদের অভিনন্দিত করবে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় রাজনীতিতে যতই টানাপড়েন থাকুক না কেন, শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক ধারা চালু হবে। আমরা আশা করি, শিক্ষার্থীদের ভোটে যারাই নির্বাচিত হোন না কেন, শিক্ষার্থীদের ওপর চেপে বসা দীর্ঘদিনের নিপীড়নমূলক সংস্কৃতির অবসান তারা ঘটাবেন। চাকসু নির্বাচন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে ত্বরান্বিত করুক।
সফিক চৌধুরী : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!