চাই ধর্মীয় শিক্ষক, চাই সংগীত শিক্ষকও
আমির খান অভিনীত ‘তারে জমিন পার’ সিনেমাটি আমরা অনেকেই দেখেছি। অদ্ভুত পোশাকে নাচের ভঙ্গিতে শিক্ষক আমির খান ক্লাসে ঢোকেন। কেন এভাবে ঢোকেন? সারা পৃথিবীতে শিক্ষক প্রশিক্ষণে এটাই শেখানো হয়। শেখানো শিক্ষার্থীদের দিনের শুরুটা যেন নাচেগানে ভরপুর হয়। শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথও শিক্ষা নিয়ে তাই বলেছেন।
মনতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার শাখাহাতী চরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশের চরশাখাহাতী ১নং প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এক বছরেই তিনবার ভাঙনের মুখে পড়ল। পাশেই আছে বৈলমন্দিয়ার খাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কোথাও পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী নেই। কয়েকবার অভিভাবক সমাবেশ হয়েছে, ফল পূর্ববৎ, মানে আগেও যা পরেও তা। কেন?
চরশাখাহাতী ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শামিমা বলেন, বিস্কুট যখন চালু ছিল, তখন স্কুল ভর্তি ছিল।
চরের বাসিন্দা মাঈদুল (৪০) বলেন, ৫/৬টি প্রাইমারি স্কুল থাকলেও একটাও হাই স্কুল নেই। প্রাইমারি শেষ করার পর ব্যবস্থা না থাকায় লেখাপড়ার আগ্রহ নেই। তাই মাদ্রাসায় পড়ে। এ ছাড়া স্কুলগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষক থাকলে হয়তো এত শিক্ষার্থী ঝরে পড়ত না।
অর্থাৎ সরকার যদি পুনরায় দুপুরের খাবার চালু করে, একজন ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দান করে এবং প্রাথমিক শিক্ষা শেষে শিক্ষা অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা রাখে, তাহলে শিক্ষার্থীরা ফিরে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
এটা গেল শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করার দিক। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার মানের অবনতি রোধ? সে প্রসঙ্গে কড়াই বরিশাল চরের চিলমারী ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফারজানা জেনি জানান, শিক্ষার মানোন্নয়নের সঙ্গে সংগীত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিনোদন বা সুর ছাড়া পাঠ শিক্ষার্থীদের মাথায় প্রবেশই করবে না। পাঠদান শুরুর আগে তাই সংগীত ক্লাস থাকলে শিক্ষা আনন্দময় হতো।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
দুই.
লেখাপড়ার মানের অবনতির কারণে সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীশূন্য হয়ে যাচ্ছে, শিশুদের মানসিক ও আদর্শিক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সরকার সেদিকে লক্ষ না করে গানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে। এর প্রতিবাদ জানাতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে দেশের ইসলামপ্রেমী জনগণ রাজপথে নামতে বাধ্য হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগের সরকারি সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে কথাগুলো বলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম।
১৭ সেপ্টেম্বর বুধবার দুপুরে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক সেমিনারে এসব কথা বলেন জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নেতারা। দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে এই সেমিনারের আয়োজন করে জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ। এতে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে ছয়টি প্রস্তাবও তুলে ধরা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার কঠোর সমালোচনা করেছেন কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের নেতারা। তারা বলেছেন, সংগীত শিক্ষকের জায়গায় সরকারকে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে দেশের ইসলামপ্রেমী জনগণ রাজপথে নামতে বাধ্য হবে।
তিন.
মস্তিষ্কের বিকাশের সঙ্গে সংগীতের সম্পর্ক নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই গবেষণা করছেন। সংগীত শোনা, শেখা বা চর্চা করা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশকে সক্রিয় করে এবং মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদাহরণ হিসেবে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ও সত্যেন বসুর নাম নিতে পারি। দুজনেই সংগীতের সমঝদার তো ছিলেনই, খুব ভালো বেহালাও বাজাতেন। মস্তিষ্কের তিনটি অংশ, যথা- সেরিব্রাম, সেরিবেলাম ও ব্রেনস্টেম। সংগীত মস্তিষ্কের প্রায় সব অংশেই প্রভাব ফেলে, তবে কাজ করার ধরন আলাদা।
১. সেরিব্রাম বা মস্তিষ্কের বৃহৎ অংশ শব্দ ও সুর বিশ্লেষণ করে। গান শুনলে ভাষা বোঝার অংশ সক্রিয় হয়। এবং পুরনো স্মৃতি জেগে ওঠে। সুর বাজানো বা রচনা করার সময় কপালের ওপরে বা মস্তিষ্কের সামনের অংশ সক্রিয় হয়। এ কারণে ক্লাসে পাঠদান গান দিয়ে শুরু হয়। ওয়াজগুলো হামদ-নাত দিয়ে শুরু হয়।
২. সেরিবেলাম বা অণুমস্তিষ্ক সংগীতের বিট, তাল ও রিদম ধরতে সাহায্য করে। এবং সুরের সঙ্গে হাততালি দেওয়া, নাচা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো- এসব সেরিবেলাম নিয়ন্ত্রণ করে। নাচ বা বাজনার সময় শরীর ও মস্তিষ্কের সমন্বয় ঘটায়। এ কারণে পীর-মাশায়েখের ভক্তরা ধ্যানস্থ হলে নেচে ওঠেন বা নেচে নেচে জিকির করেন।
৩. ব্রেনস্টেম বা মস্তিষ্ককাণ্ড খুব জোরে বা হঠাৎ কোনো শব্দ শুনলে দেহকে চমকে ওঠার সংকেত দেয়। মিউজিক শোনার সময় ডোপামিন বা আনন্দ হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে, যা আনন্দ বা প্রশান্তি আনে। এ কারণে আগেকার দিনে যুদ্ধের ময়দানে ঢাক বাজানো হতো। এখন কনসার্টগুলোতে তাই করা হয়। এতে শিশুদের ভাষা শেখা সহজ হয়। সংগীতের ছন্দ ও সুর শিশুদের শব্দ চিনতে, উচ্চারণ শিখতে এবং ভাষা বোঝার ক্ষমতা বাড়ায়। এবং তারা সহজে শব্দ ও বাক্য মনে রাখতে পারে। পাঠে মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে।
স্নায়ুবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সংগীত শোনার সময় মস্তিষ্কের ডান ও বাম অংশ দুই-ই সক্রিয় হয়। স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ, অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং চিন্তা ও সিদ্ধান্ত সংগীত দ্বারা উদ্দীপিত হয়। সহজভাবে বললে, সংগীত হলো মস্তিষ্কের জন্য এক ধরনের ‘ব্যায়াম’- যা বুদ্ধি, স্মৃতি, আবেগ, মনোযোগ ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়।
আরও পড়ুন:
পুঁজিনির্ভর রাজনীতি এবং তারাবাজির নির্বাচন
শিশুদের স্কুল শিক্ষা থেকে সংগীত বাদ দিলে যে বড় ক্ষতি হয়, যেগুলো মস্তিষ্ক, মানসিকতা, সামাজিক দক্ষতা ও সৃজনশীলতায় প্রভাব ফেলে- সংগীত শিশুদের স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ, ভাষা শেখা ও গণিতের দক্ষতা বাড়ায়। গবেষণায় দেখা যায়, সংগীতচর্চা শিশুদের আইকিউ ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বাড়ায়। সংগীত না থাকলে এই বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায় না। সংগীত শিশুদের চাপ কমাতে, আবেগ প্রকাশ করতে ও মানসিক ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে। এটি না থাকলে শিশুরা আবেগ প্রকাশের সহজ পথ হারায়, ফলে হতাশা বা অস্থিরতা বেশি হতে পারে।
কোরাস, বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিশুদের সহযোগিতা, নেতৃত্ব ও সামাজিকীকরণ শেখায়। বাদ দিলে দলগত কাজ শেখার একটি কার্যকর মাধ্যম হারিয়ে যায়। সংগীত একটি জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বড় অংশ। ছোটবেলা থেকে এটি না শিখলে শিশুরা সংস্কৃতি ও শিকড় থেকে দূরে সরে যেতে পারে। আমরা নিশ্চয়ই এমনভাবে শিশুদের গড়ে তুলতে চাই না। আমাদের ধর্মীয় শিক্ষকও লাগবে, লাগবে সংগীত শিক্ষকও।
নাহিদ হাসান : লেখক ও সংগঠক
মতামত লেখকের নিজস্ব