পুঁজিনির্ভর রাজনীতি এবং তারাবাজির নির্বাচন
শিল্পমাধ্যম এবং রাজনীতি আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন দুই মেরু মনে হতে পারে। কিন্তু ভোটের হাওয়ায় দুটোই মিলেমিশে একাকার! আমাদের রাজনীতি তার উৎকর্ষ হারিয়েছে। হারিয়েছে শিল্পগুণ। আবার অন্য অর্থে রাজনীতি এখন বড় এক শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রিজ। এখানেও বড় বিনিয়োগ লাগে। অর্থ লাগে। কর্মী লাগে। রাজনীতি নামক শিল্পে বিনিয়োগে এখন ক্ষতির আশঙ্কা কম। বরং লাভ-ই বেশি। তাই ব্যবসায়ীরা ছুটছেন রাজনীতির পেছনে! আমাদের দেশে সেটা গেল শতাব্দীর সত্তর দশক থেকে। যখন এক জেনারেল ক্ষমতায় এসে বলেছিলেন, ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ান!’ রাজনীতি তখন থেকেই রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হতে শুরু করে। পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদদের মুখে এখন শুনতে হয়, ‘রাজনীতি করতে টাকা লাগে। নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে টাকা লাগে! জনগণের ভোট পেতেও টাকা লাগে!’ তাদের কথাগুলো মনে হয় দীর্ঘশ্বাস হয়ে ভোটের মাঠে ঝরে পড়ে! আসলেই রাজনীতি নামক শিল্পে টাকা লাগে।
ভোটের রাজনীতিতে জনগণই নির্ণায়ক। কিন্তু অর্থ হচ্ছে নিয়ন্ত্রক। নির্বাচনী হলফনামায় প্রার্থীরা যে সম্পদের বিবরণ জমা দেন সেখানে সত্য লুকান কিনা তার আভাস পাওয়া যায় গণমাধ্যমের খবরে। শিল্পমাধ্যম বা খেলার মাঠ থেকে এসে যারা রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন তাদের বড় সম্পদ জনগণের আবেগমথিত আবেগ। সেই হিসাবটা অবশ্য তারা কোনো বিবরণ হিসাবে জমা দিতে পারেন না। কারণ আবেগের পরিমাপ করা কঠিন। কিন্তু মানুষের আবেগতাড়িত তারকাখ্যাতিতে ভাটার টান দেখা দিলেও রাজনীতিতে নামলে তাদের সম্পদ বেড়ে যায়! ক্রিকেট তারকা হিসেবে যিনি ভোটের মাঠে নেমেছিলেন এবার রাজনীতিবিদ হিসেবে তার সম্পদ বেড়েছে। পেশা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের আকারও পাল্টে যাচ্ছে। পেশা হিসেবে রাজনীতি অনেক লাভজনক। বাংলাদেশ দলের এক সাবেক অধিনায়ক ক্রিকেটার থেকে সংসদ সদস্য হওয়ার পর এবার তার পেশা উল্লেখ করেছেন রাজনীতি। তার সম্পদ বিবরণীও পাল্টেছে। বেড়েছে তার সম্পদও!
তারকাখ্যাতির বিনিময়ে যারা সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পান সেখানে বিনিময় মূল্য হওয়ার কথা কাজ। রাজনীতি বিশ্লেষক থেকে মনোবিদরা তেমন কথাই বলেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পেছনে এবার শুধু তার পুরনো তারকা ইমেজ কাজ করেনি। তিনি জনগণের জন্য কতটা কাজ করেছেন সেটাই সামনে চলে এসেছে। সেই বিবেচনায় নিজের উইকেট অক্ষত রাখতে পেরেছেন তিনি। জাতীয় দলের অধিনায়ক থেকে জনগণের নেতা হওয়ার একটা উদগ্র ইচ্ছে তার মধ্যে কাজ করে। সাধারণ মানুষের নেতা হতে গেলে তাদের সঙ্গে মিশতে হবে। তাদের কথা শুনতে হবে। তাদের জন্য কাজ করতে হবে। এই তিনটা বিষয় বেশ ভালো জানা মাশরাফীর। এলাকার মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন খুব সহজেই। সংসদ সদস্য হওয়ার পরও এলাকায় গিয়ে নেমে পড়েন খেলার মাঠে! চিত্রা নদীর পারের প্রতিটি মহলা, প্রতিটি এলাকার মানুষের কাছে তিনি এখনো তাদের সেই ‘কৌশিকরূপে মাশরাফী!’ এমপি সাহেবের মোড়ক এখনো তাকে মুড়ে ফেলতে পারেনি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
রাজনীতির ‘নীতি’র চেয়ে মাশরাফীকে মানুষ বেশি পছন্দ করেছিল মানুষ হিসেবে। এখনো তাই। এই একটা স্টার কাস্টিং আওয়ামী লীগের সঠিক। যে কারণে দলীয় রাজনীতিতেও তার গুরুত্ব বেড়েছে। দলের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্বও পেয়েছেন তিনি। জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক থেকে নড়াইলে নৌকার মাঝি তিনি।
তার পাশের জেলায় আরেক আসনে নৌকার মাঝি করা হয়েছে জাতীয় দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। অর্থ-খ্যাতি সবই আছে তার। ক্রিকেট মাঠের বাইশ গজের দাপট রাজনীতির মাঠে তিনি দেখাতে পারেন কিনা সেটা দেখার জন্য তাকিয়ে ক্রিকেট মহল থেকে রাজনৈতিক মহল। ক্রিকেট-পরবর্তী জীবন রাজনীতিকে পেশা হিসেবে তিনি নেবেন কিনা তা নিয়েও সংশয় আছে। রাজনীতি বিশ্লেষক, মনোবিদরা নানা তত্ত্বে তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অনেকে বলছেন, সাকিবের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি কদিন দেশে থাকবেন! তাদের এই যুক্তির গুগলিকে বাউন্ডারি লাইনের ওপারে ফেলা সহজ নয়। কিন্তু ডিফেন্স করা যায়। পাল্টা প্রশ্ন করা যায়, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের কজনের ছেলেমেয়ে দেশে পড়াশোনা করছেন বা বসবাস করছেন! শুধু রাজনীতিবিদ কেন, আমলা, ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই বিদেশে। তা হলে সাকিবের বেলায় প্রশ্ন কেন?
প্রশ্নÑ কারণ সাকিব তারকা। তার যশ-খ্যাতি অন্য ব্যবসায়ীরাও ব্যবহার করেন। এই জায়গায় সাকিব আল হাসান পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী! ‘ফেল কড়ি মারো তেল’Ñ ফর্মুলায় তিনি ফিতা কাটেন কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় তাদের পণ্য নিয়ে হাজির হচ্ছেন। পণ্যের মডেল হওয়ার চেয়ে অনেক কঠিন রাজনীতির মডেল হওয়া। সেটা সাকিবের একেবারে অজানা নয়। আবার জানা সেটাই বা বলছি কীভাবে! নির্বাচনের বাইশগজে নামার সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে আইন বা আচরণবিধি ভাঙার অভিযোগ। ভুল স্বীকার করে বেনিফিট অব ডাউট পেলেন তিনি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ক্রিকেটার সাকিবকে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কম হয়নি। ক্রিকেটার হয়ে ক্রিকেটের অনেক আইনকানুনের তোয়াক্কা তিনি করেননি! তার পরও এ দেশের মানুষ তার নামে স্লোগান দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের জান.. সাকিব আল হাসান!’ সেই দেশের মানুষ তাকে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি বানাবেন এটা আশা করা যায়। কিন্তু তিনি জনগণকে কী দেবেন সেই প্রশ্নটাও সামনে চলে আসে। জনগণকে শুধু দেওয়া নয়, তাদের সঙ্গে তারকা সাকিবের আচার-আচরণ, ব্যবহার কতটা জনপ্রতিনিধিসুলভ হয় সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
সাকিব-মাশরাফীদের মতো তারকাকে মনোনয়ন দেওয়া যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য সহজ কাজ। কারণ এদের নিয়ে রাজনৈতিক দায় কম থাকে। এরা জয়ী হলে দল তাদের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বা কৃতিত্বের চেয়ে বেশি বলেন দলের নেতাকর্মীদের কথা। আর হারলে সেই অর্থে দলীয় রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়ে না। হারলে বলা যায়, তারকারা তো আর রাজনীতির লোক নন। স্বতন্ত্র বা বিরোধী প্রার্থী অনেক শক্তিশালী বলে যুক্তি দাঁড় করানো যাবে। সাম্প্রতিককালের ভোটের ইতিহাস বলছে, আওয়ামী লীগের তারকা প্রার্থীদের তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা যা তার খানিকটা মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে। যেমন এবার আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাননি বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়। মনোনয়ন পাননি জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক এবং সাবেক উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়। সাবেক তারকা ফুটবলার এবং আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল। তার এলাকায় দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন গায়িকা মমতাজ। টুটুল প্রার্থী হয়েছেন স্বতন্ত্রভাবে। লড়াই তার নিজের দলের প্রার্থীর সঙ্গে। আবাহনীর সাবেক তারকা ফুটবলার টুটুলের সঙ্গে ভোটের মাঠে লড়াই গায়িকা মমতাজের। মানিকগঞ্জের এই আসনে তারকা লড়াই হলেও হতে পারে। তবে ওই আসনের নির্বাচনী ইতিহাস বলে, এলাকার মানুষ তারকাকে ভোট দেওয়ার জন্য আপ্লুত হয়ে বসে থাকেন তা নয়। গায়িকার গানে মুগ্ধ হয়ে কিংবা ফুটবল তারকার ফুটবল জাদুতে আচ্ছন্ন হয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন বিষয়টা মোটেও তা নয়। নির্বাচনী হাঁকডাক, চিৎকার-চেঁচামেচিতে তারকাদের প্রচার-প্রচারণা বেশি। কিন্তু শিল্পপতি প্রার্থীরাও প্রচারণায় খুব পিছিয়ে থাকছেন না। সংবাদমাধ্যম, সমাজমাধ্যমে তারাও সরব। মাঝখানে নীরব শুধু সেসব রাজনীতিবিদ। জীবন-যৌবনের বড় একটা সময় যারা জনগণের কথা বলতে, জনগণের সঙ্গে চলতে রাজপথে, রাজনীতির মাঠে ব্যয় করেছেন! অবিশ্বাস্য বিস্ময় নিয়ে তারা তাকিয়ে থাকেন নির্বাচন নামক গণতন্ত্রের নির্ণায়কের দিকে!
অঘোর মন্ডল : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২