‘সন্ত্রাসবাদী’ ম্যান্ডেলা, ৭৫ বছরের জাতিনিধন, কিসিঞ্জারের অশুভ অস্তিত্ব
কিউবায় স্থানীয়দের মধ্যে একটি প্রবাদবাক্য চালু আছে এরকম, ‘যা অশুভ তা একশ বছর টেকে না।’ এ প্রবাদবাক্য ভুল প্রমাণ করার জন্যই হয়তো একশ বছর টিকে ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। কয়েকদিন আগে তিনি মারা গেছেন। তাকে নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আমরা শুধু তার একশ বছরের আয়ুষ্কাল আর কিউবান প্রবাদ স্মরণ করলাম, কেননা মানবজাতির পক্ষে হেনরি কিসিঞ্জারের অস্তিত্ব অশুভ হলেও তিনি ঠিকই একশ বছর টিকে ছিলেন।
কিসিঞ্জার নন, মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘এ কথা আমরা খুব ভালো করে জানি যে, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ।’
এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে এটি খুব স্বাভাবিক যে, ম্যান্ডেলাকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা সেঁটে দেবে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৮ সালের আগে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘সন্ত্রাসবাদী’ ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। ঠিক এখন যেমন হামাস তাদের কাছে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। এটি নতুন বিষয় নয়। সাম্রাজ্যবাদী-ঔপনিবেশিকরা তাদের অপছন্দের ব্যক্তি বা সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী বলে আখ্যায়িত করে আসছে যুগ যুগ ধরে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা তিতুমীর, ক্ষুদিরামসহ সব ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, অনুশীলনসহ সব স্বাধীনতাকামী সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। ইতিহাসের সেই ধারা আজও তারা বজায় রেখে চলেছে বিশে^র দিকে দিকে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
হামাস হচ্ছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন, জাতীয় মুক্তির আন্দোলন। জায়নবাদী ঔপনিবেশিক হানাদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার যে অধিকার রয়েছে, সেই অধিকার হরণ করতেই হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের তকমা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা, এমনকি ভারতও। ইসরায়েলি দখলদারিত্ব থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জনের কৌশল কী হবে, কারা নেতৃত্ব দেবে এবং কারা কীভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করবেÑ এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ফিলিস্তিনি জনগণ। এগুলো দখলদারদের অনুমোদন ও সম্মতির অপেক্ষা রাখে না। তাই হামাসকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বললেই হামাস সন্ত্রাসবাদী হয়ে যায় না। বরং ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে যে ধারাবাহিক নৃশংসতা চালিয়ে আসছে বহিরাগত জায়নবাদীরা, মূলত তারাই সন্ত্রাসবাদী। এই জায়নবাদীরা দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালীন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর চেয়ে কোনো অংশে কম তো নয়ই, বরং কিছু ক্ষেত্রে বেশি।
হামাস হচ্ছে ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন। এ সংগঠন লড়াই করছে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে, লড়াই করছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য। এ লড়াই ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্ব ও অধিকার রক্ষার লড়াই। মাতৃভূমিতে দখলদারিত্ব প্রতিরোধ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক আইনে। হামাস আন্তর্জাতিক আইনে সঠিক অবস্থানে রয়েছে। এই আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, দখলদারদের প্রতিরোধ করার অধিকার আছে স্থানীয় জনগণের এবং সেটি যে কোনো উপায়ে।
ফিলিস্তিনি ইতিহাসবিদ খালেদ সাইদ আল-তাহের লিখেছেন- আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার আইন ও জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের পক্ষে ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ’ সম্পূর্ণ বৈধ ও আইনসিদ্ধ। নিজেদের ভূমিতে বসবাসরত স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে দখলদার ইসরায়েল বেআইনিভাবে বিমান, সেনা ও নৌবাহিনী ব্যবহার করছে। যেসব দেশ হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে বিবেচনা করে না সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইরান, রাশিয়া, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, চীন, কাতার, ব্রাজিল প্রভৃতি। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় বিশে^র ৮০ শতাংশ মানুষ, অর্থাৎ জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৩৬টি দেশ। ইসরায়েল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকার করে না। ফিলিস্তিনিরা নয়, ইসরায়েল সরকারই জাতিনিধন চালিয়ে যাচ্ছে ৭৫ বছর ধরে।
হামাস শুধু মার খায় না, পাল্টা মার দেয়- সেজন্য সে সন্ত্রাসবাদী। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের কথা মনে আছে নিশ্চয়, তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। আশ্চর্যের কিছু নেই যে, সিরিয়া ও অন্যান্য দেশে আসল সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলোকে তিনিই প্রতিপালন করছিলেন। পশ্চিমাদের এই ভণ্ডামি সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। স্বাধীনতা সংগ্রামী আর সন্ত্রাসবাদীর মধ্যে আমাদের অবশ্যই পার্থক্য করতে হবে। ইহুদি মালিকানাধীন পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এই পার্থক্য মুছে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাকেও সন্ত্রাসবাদী বানাতে চায়। আপনি কেন তা মানবেন?
গাজা উপত্যকায় হামাস গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার। যে নির্বাচনে হামাস এই গণরায় পেয়েছিল, তাতে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি হামাসকে ভোট দিয়েছিল, কারণ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিরোধ সংগঠন হিসেবে হামাসকে তারা স্বীকৃতি দেয়।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
হামাস ২০১৪ সালের এপ্রিলে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল মানবাধিকারের শর্তে। সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এটি পরিষ্কার যে, নেতানিয়াহু শান্তি চান না, তিনি চান ফিলিস্তিনি ভূমি ও সম্পদ। এজন্য গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিতে চান তিনি। শিশুদের লক্ষ্যবস্তু করা এবং ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় ডাইম (ডেন্স ইনার্ট মেটাল এক্সপ্লোসিভ), হোয়াইট ফসফরাস ইত্যাদি আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ অস্ত্র প্রয়োগ করে ব্যাপক গণহত্যা চালানোÑ এসব অপরাধ হামাস করেনি, করেছে জায়নবাদী ইসরায়েল।
২০১৪ সালের এপ্রিলে হামাস যেসব শর্তে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল এবং নেতানিয়াহু যে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেগুলো হচ্ছে- গাজা সীমান্ত থেকে ইসরায়েলি ট্যাংক প্রত্যাহার; অবরোধ তুলে নিয়ে বাণিজ্য ও জনচলাচলের জন্য সীমান্ত ক্রসিং খুলে দেওয়া; জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি আন্তর্জাতিক বন্দর ও বিমানবন্দর স্থাপন করা; মাছ ধরার অনুমোদিত জলসীমা ১০ কিলোমিটার বাড়ানো; জাতিসংঘ ও কয়েকটি আরব দেশের তত্ত্বাবধানে রাফা ক্রসিংকে আন্তর্জাতিকীকরণ; সীমান্তে আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন; আল-আকসা মসজিদে নামাজ পড়ার অনুমতি পাওয়ার শর্ত সহজ করা; গাজা উপত্যকায় শিল্পাঞ্চল পুনঃপ্রতিণ্ঠা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উন্নয়ন; হামাস ও ফাতাহ্র মধ্যে সম্পাদিত একত্রীকরণ চুক্তিতে ইসরায়েলি হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করা।
এসব শর্তের কোনো একটিও কি অগ্রহণযোগ্য? নিশ্চয় নয়। কিন্তু নেতানিয়াহু গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। কেন? গাজা উপত্যকা থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের তাড়িয়ে দিয়ে অঞ্চলটি দখল করার মধ্যে আর্থ-ভূরাজনৈতিক কী স্বার্থ আছে নেতানিয়াহু ও তার মিত্রদের? এ বিষয়ে আমরা নজর দেব আগামী লেখায়।
হেনরি কিসিঞ্জারের কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল, তার কথা দিয়েই শেষ করা যাক। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক তার নীতি ছিল- আরবদের ঐক্য ভেঙে দেওয়া। এর অর্থ কী হতে পারে, ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। তার আরেকটি নীতি ছিল- ফিলিস্তিনিদের বিশ^ সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। এরও অর্থ ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। হয়তো এ কারণেই মানবজাতির পক্ষে অশুভ অস্তিত্ব ছিলেন কিসিঞ্জার। কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। কিসিঞ্জার কিংবা ইসরায়েলও শেষ কথা নয়।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২
প্রমিত হোসেন : গল্পকার, ঔপন্যাসিক; ফিকশন, নন-ফিকশন অনুবাদক; আমাদের সময়ের সহযোগী সম্পাদক