নজরদারি ও নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন

সবজির দাম ঊর্ধ্বমুখী

সম্পাদকীয়
১২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
নজরদারি ও নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন

রাজধানীর কাঁচাবাজারে সাম্প্রতিক সময়ের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর ভয়াবহ চাপ তৈরি করেছে। বৃষ্টিপাতের কারণে সবজির সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম চড়েছে হু-হু করে। এমন পরিস্থিতিতে সমাজের বৃহত্তম ও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ একটি শ্রেণি নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষ টিকে থাকার লড়াইয়ে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।

ঢ্যাঁড়স, কাঁকরোল, ঝিঙা, ধুন্দল, পটোল কিংবা কচুরলতি- সবকটিরই দাম ৮০ টাকার নিচে নেই। করলা, বরবটি, টমেটো কিংবা বেগুনের দাম পেরিয়ে গেছে শত টাকার ঘর। এ চিত্র কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং আমাদের বাজারব্যবস্থার এক পুরনো ব্যাধি- যে কোনো অজুহাতেই দাম বাড়ে দ্রুত, কিন্তু কমতে সময় লাগে অনেক। বৃষ্টি হোক, উৎসব হোক, আমদানি ব্যাহত হোক বা সরবরাহে সামান্য টান পড়ুক- মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতের অভাব হয় না। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সে দাম আর সহজে নেমে আসে না। এর মধ্যেই বিপাকে পড়ে নিম্ন ও মধ্য আয়ের বিপুল জনগোষ্ঠী, যাদের জীবিকা টিকে আছে সীমিত আয়ের ওপর।

শুধু সবজি নয়, অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারেও একই চিত্র। চালের দাম ক্রমেই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। মাঝারি ও মোটা চালের দামও একইভাবে বাড়তি। খোলা ভোজ্যতেলের দাম লিটারে কমপক্ষে ২ টাকা বেড়েছে, দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়। মাছের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও মুরগির বাজারে অস্থিরতা স্পষ্ট- ব্রয়লার মুরগি ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা, আর সোনালি মুরগি ৩০০ টাকার ওপরে। ফার্মের বাদামি ডিমের দামও ডজনপ্রতি ১৪০ টাকার আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। ফলে গৃহস্থালির মাসিক বাজেটে যে টান তৈরি হচ্ছে, তা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সহনীয় সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

এই অবস্থার পেছনে কেবল মৌসুমি বা প্রাকৃতিক কারণই দায়ী নয়। এর পেছনে রয়েছে বাজারব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা ও নিয়ন্ত্রণহীনতা। পাইকারি পর্যায়ে অল্প সরবরাহ বা মৌসুমি বৃষ্টিপাতকে পুঁজি করে প্রভাবশালী মহল প্রায়ই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এই সুযোগে খুচরা বাজারে দাম লাফিয়ে ওঠে। কিন্তু সরবরাহ স্বাভাবিক হলেও দাম নামানোর তাগিদ কারও মধ্যে দেখা যায় না। ফলে একবার বাড়া দাম অনেক সময় মাসের পর মাস ভোক্তার কাঁধে বোঝা হয়ে চেপে থাকে।

বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ অনেক সময়ই হয় তাৎক্ষণিক ও খণ্ডিত। মূল্যবৃদ্ধির পর কয়েকদিনের জন্য অভিযান বা তদারকি বাড়ানো হয়, কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান আসে না। অথচ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর নীতিগত পদক্ষেপ।

একদিকে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে, অন্যদিকে ভোক্তার জন্য দাম রাখতে হবে সহনীয় পর্যায়ে। এজন্য দরকার শক্তিশালী পাইকারি বাজার ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহনের অবকাঠামো উন্নয়ন। আমদানিনির্ভর পণ্যের ক্ষেত্রে আগেভাগে ও সময়োপযোগী আমদানির ব্যবস্থা নিতে হবে, যেন উৎসব বা মৌসুমি প্রভাবে সরবরাহ ব্যাহত না হয়। একই সঙ্গে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী ও বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- এই মূল্যবৃদ্ধির চাপ নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় যে বিপর্যয় ডেকে আনে, তা মোকাবিলায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও শক্তিশালী করতে হবে। ভর্তুকিভিত্তিক পণ্য বিক্রি ও খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো জরুরি, যেন মৌলিক খাদ্যনিরাপত্তা অন্তত নিশ্চিত থাকে।

বাজারে দাম বাড়ার এই দ্রুতগতি আর কমার ধীরগতি শুধুই অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই বাজারব্যবস্থায় কৌশলগত পরিবর্তন, নজরদারি জোরদার এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি। কেননা বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে চাইলে এ অস্বস্তির মূল কাঠামোতেই আঘাত হানতে হবে- অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা দিয়ে নয়, স্থায়ী নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে।