সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম চিরজীবী থাকুন আমাদের মাঝে

মোহীত উল আলম
১২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম চিরজীবী থাকুন আমাদের মাঝে

একদিন কোথাও লাঞ্চের পর ঢেঁকুর তুলে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ভাইকে আমার পেটের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, পেট বেড়ে যাচ্ছে। মনজুরুল ভাই বললেন, ‘টেক ইট ইজি, ইউ আর নট গেটিং অ্যানি ইয়াংগার।’ এরপর একটি অমোঘ কথা বললেন, ‘মোহীত, আমরা হয়তো আর দশ-বারো বছর বাঁচব। তারপর সব শেষ।’ যদিও কথাটা ধ্রুব সত্য, তার পরও আমি চমকে উঠেছিলাম।

মনজুরুল ভাইয়ের এই অকালমৃত্যুটা আমি, ফকরুল ভাই বা কায়সার ভাই- কেউ সহজভাবে মেনে নিতে পারছি না। অধ্যাপক ফকরুল আলম আর অধ্যাপক কায়সার হক মনজুরুল ভাইয়ের দুই বছরের জুনিয়র, আর আমি তিন বছরের। ফকরুল ভাই সব সময় বলতেন, মনজুরুল ভাই ইজ ইউনিক। এমন একটা হেলথ, কোনো বাধা-বিঘ্ন নেই। অথচ সেই মনজুরুল ভাই আমাদের অবাক করে দিয়ে চলে গেলেন।

মনজুরুল ভাইয়ের প্রতি আমার মুগ্ধতার শুরু বুদ্ধদেব বসুর কারণে। শুনতাম, এবং পরে তার আত্মজীবনীতে পড়েছিলাম যে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে বিএ অনার্স এবং এমএতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। পরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির ছাত্র হলে কিছুটা দীর্ঘ চুলের অধিকারী সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে দেখতে পাই ডিপার্টমেন্টের করিডরে আরও দীর্ঘ চুলের বাহারি আরেকজনের সঙ্গে একত্রে ঘুরতে। সেই আরেকজন হলেন অধ্যাপক কাজী মোস্তায়ীন বিল্লাহ্, মনজুরুল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে মনজুরুল ভাইদের অনার্সের রেজাল্ট বের হয়, তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। শরীফ মিঞার ক্যান্টিনে আমি তাকে অবাক চোখে দেখি, যেন একজন বুদ্ধদেব বসুকে দেখছি। সে সময় দৈনিক বাংলার ‘বিচিত্রা’ শীর্ষক সাপ্তাহিকীতে কারও গল্প ছাপা হওয়া মানে কেল্লা ফতে। মনজুরুল ভাইয়ের একটা গল্প ছাপা হয়। নামটা মনে করতে পারছি না। ইংরেজি সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় ছাত্র হয়ে সৃজনশীল বাংলার জগতে ঢোকার জন্য তিনি ঢাকার তরুণ লেখক সম্প্রদায় থেকে বেজায় সুনাম পেলেন।

এই সুনাম মনজুরুল ভাইয়ের সারাজীবন অক্ষুণ্ন থাকে। মনজুরুল ভাই এমএ রেজাল্টেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। কবীর চৌধুরী স্যারের বরাত দিয়ে কেউ একজন আমাকে জানালেন, মনজুরুল ভাই বুদ্ধদেব বসুর প্রাপ্ত মার্ক্সের চেয়েও বেশি পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ফকরুল ভাই ও কায়সার ভাইও যখন একই ব্রিলিয়ান্স দেখালেন, তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতায় ঢুকে বিল্লাহ্ স্যারকে পেলাম সহকর্মী হিসেবে এবং সেই সুবাদে মনজুরুল, ফকরুল আর কায়সার ত্রয়ীর চবির ইংরেজি বিভাগের মধ্যে বহিঃশিক্ষক হিসেবে আগমন হতে লাগল।

এর আরও বছর দশেক পরে আমি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে যোগদান করলে, বিভাগটির ব্র্যান্ডিং করার জন্য বাংলাদেশের ইংরেজি সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় এই ত্রয়ীকে বিভাগের শিক্ষার্থীদের পাঠ দান করার ব্যবস্থা নিতে একটা মেকানিজম তৈরি করলাম। সঙ্গে রাখলাম ‘মান্থলি লিটারারি সেমিনার’। ফলে হলো কি, মনজুরুল ভাইসহ বাকি দুজন মাসে অন্তত একবার এসে ডেল-এ পাঠদান ও সেমিনারে উপস্থিত থেকে বিভাগের পুরো চেহারাই একেবারে পাল্টে দিলেন। বিভাগটা সত্যিই দাঁড়িয়ে গেল। আমরা এই ব্যবস্থা ১/১১ আসার আগে পর্যন্ত, অর্থাৎ বছর তিনেক চালু রাখতে পেরেছিলাম। আরও অনেক পরে মনজুরুল ভাইসহ আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন দিনব্যাপী নজরুল উৎসবে যোগ দিতে গেছি, তখন কি-নোট স্পিকার হিসেবে মনজুরুল ভাইয়ের চমৎকার ভাষণটি শুনে আমি মনে মনে ভাবলাম আর গর্ব অনুভব করলাম, কেমন একটা গুণী লোকের সঙ্গে আমি ওঠাবসা করি! ভারতীয় অডিয়েন্স খুবই ইমপ্রেসড হলো। একাডেমিক অঙ্গনের বাইরে মনজুরুল ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঢাকায় বা চট্টগ্রামে মাঝে মাঝে আড্ডা হতো। মনজুরুল ভাই সপ্রতিভ, উইটি এবং হিউমারাস ছিলেন। ভীষণ বুঝতেন মানবচরিত্র। অল্প হাসির ছটার মধ্য দিয়ে তিনি অনেক সিরিয়াস অভিমত দিয়ে দিতেন। তার বাসায় যখনই গেছি ভাবির স্নিগ্ধ আপ্যায়নে আপ্লুত হয়েছি। তাদের একমাত্র ছেলের বিয়ে হয়েছিল ঘটা করে। তবে মনজুরুল ভাই কথা কমই বলতেন; এবং নিজের সম্পর্কে অতি-সজাগ ছিলেন। মনজুরুল ভাই প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর সম্পর্কে নাতি। আমি আড্ডার এক ফাঁকে বোকার মতো বললাম, উনি তো খুব ফর্সা ছিলেন। মনজুরুল ভাই কথাটা সহজভাবে নিলেন না। ভেতরে ভেতরে খুব সেনসিটিভ ছিলেন, এবং কোনো কারণে অসন্তুষ্ট হলে তখন মুখের ওপর বলে ফেলতেন। একবার উনি আর আমি সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই এক্সটার্নাল হিসেবে। তখন সেখানে কারও আচরণে তিনি এতটাই অসন্তুষ্ট হলেন যে প্রায় বোর্ড ছেড়ে চলে আসবেন সে রকম অবস্থা। আমরা তার মেজাজ নরম করতে বেশ বেগ পাই। আমি ইউল্যাবে ইংরেজি বিভাগের হেড ও কলা অনুষদের ডিন হিসেবে জয়েন করার কিছু পরে মনজুরুল ভাইও জয়েন করেন। আরও কিছুদিন পর গোলাম সারোয়ার চৌধুরীও জয়েন করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে জয়েন করেন কায়সার হক। ফলে ইউল্যাবের ইংরেজি ও মানববিদ্যা বিভাগ দীপ্যমান হয়ে ওঠে।

মনজুরুল ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন, এবং কথাবার্তাও ছিল বন্ধুত্ব আর উপদেশের মাঝামাঝি কিছু একটা। আমি বিভিন্ন সংকটে তার কাছে পরামর্শের জন্য ফোন করতাম। সব শেষ কথা হয়েছিল মাসখানেক আগে। প্রায় মন খুলে কথা বললেন মনজুরুল ভাই। বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের ওপর জোর দিয়ে এটাও বললেন যে, এই পথপরিক্রমা বাংলাদেশের জন্য অবধারিত ছিল। কিন্তু তখন তো জানতাম না, এটাই হবে তার সঙ্গে আমার শেষালাপ।  

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম চিরজীবী থাকুন আমাদের মাঝে।


ড. মোহীত উল আলম : শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক