চিকিৎসায় নোবেল তিন নীরব নায়কের
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যখন নির্বিচারে মানুষ মরছে, শিশুদের রক্তে লাল হয়ে উঠছে সভ্যতার মুখ, তখন পৃথিবীর সব অর্জনই যেন অর্থহীন মনে হয়। প্রতিদিন মৃত্যুর ছবি দেখে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন, প্রশ্ন করছেনÑ মানবতা আসলে কোথায় হারিয়ে গেল? এমন এক অন্ধকার সময়েই ঘোষণা করা হলো এ বছরের নোবেল পুরস্কার। গত মঙ্গলবার পৃথিবীতে ছয়টি ক্ষেত্রে নোবেল দেওয়া হয়, কিন্তু তার মধ্যে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পুরস্কার যেন আলাদা আশার বার্তা বয়ে আনে। কারণ ধ্বংসের এই যুগেও কিছু মানুষ জীবন বাঁচানোর কাজ করে যাচ্ছেন, অমৃতের সন্ধানে লেগে আছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেলজয়ীরা সেই অমৃতের সন্তানÑ যারা দেখিয়ে দেন, মানুষের ভেতর এখনও আলো বেঁচে আছে।
এ বছরের চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার ঘোষণার দিনটিতে পৃথিবী যেন কিছুটা বেশিই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। যখন চারদিক থেকে বিষাক্ত রাজনীতি, বিভাজন আর সংঘাতের খবর আসে, তখনও বিজ্ঞান তার নিজের শান্ত, ধৈর্যশীল পথে এগিয়ে চলে। মানুষের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিছু মানুষ নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ল্যাবরেটরির নীরব আলোয়, যেখানে ঘাম ঝরে কিন্তু করতালি বাজে না। এমনই তিনজন গবেষকÑ মেরি ই. ব্রানকো, ফ্রেড র্যামসডেল এবং শিমন সাকাগুচি এ বছর চিকিৎসা ও শারীরবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মানবদেহের ইমিউন সিস্টেম সম্পর্কে এক অসাধারণ আবিষ্কারের জন্য। তারা দেখিয়েছেন, কীভাবে আমাদের শরীর নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা থেকে নিজেকে রক্ষা করে। এই আবিষ্কার শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, গভীর মানবিকও বটে, কারণ এটি আমাদের শেখায় শরীর যেমন নিজের ভুল বোঝে, মানুষকেও তাই করতে শেখা দরকার।
মানুষের শরীরে ইমিউন সিস্টেম এমন এক বিস্ময়কর প্রহরী, যা প্রতিদিন অসংখ্য ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, এমনকি ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে লড়ে যায়। এটি আমাদের জীবনের অদৃশ্য ঢাল। কিন্তু এই প্রহরী কখনও কখনও বিভ্রান্ত হয়ে যায়। তখন সে শত্রু চিনতে ভুল করে এবং নিজের শরীরের সুস্থ কোষকেও শত্রু মনে করে আক্রমণ শুরু করে। একেই বলে অটোইমিউন রোগ। ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসের মতো রোগগুলো এমন ভুল আক্রমণের ফল। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে জানতেন যে, এই বিপজ্জনক প্রবণতা প্রতিরোধ করতে শরীরে এক বিশেষ প্রক্রিয়া কাজ করে, যেখানে থাইমাস নামের একটি গ্রন্থি ক্ষতিকর বা ভুল প্রতিক্রিয়াশীল টি-সেলগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। টি-সেল হলো এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা, যা শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মূল সৈন্য। কিন্তু রহস্য ছিল অন্যত্রÑ থাইমাস সব বিপজ্জনক কোষকেই নির্মূল করতে পারে না। কিছু ভুলে যাওয়া, বিপথগামী টি-সেল রক্তে বেরিয়ে পড়ে এবং সুযোগ পেলে শরীরের ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই জায়গাতেই শিমন সাকাগুচি তার যুগান্তকারী আবিষ্কারটি করেন। তিনি খুঁজে পান এমন এক শ্রেণির টি-সেল, যারা অন্য টি-সেলদের নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। যেন একটি সৈন্যদলের ভেতরেই কিছু সৈন্য রয়েছে, যারা বাকি সৈন্যদের লাগাম টেনে ধরে রাখে। সাকাগুচি এই বিশেষ কোষগুলোকে বলেন রেগুলেটরি টি-সেল। এই কোষগুলোর গায়ে থাকে একটি প্রোটিন, যার নাম সিডি২৫ (CD25) এবং এগুলোই শরীরে আত্মরক্ষার দ্বিতীয় স্তর তৈরি করে। এরা যেন ইমিউন সিস্টেমের ‘ব্রেক’। শরীরে এই ব্রেক কাজ না করলে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এক রকম বিকল হয়ে যায়- নিজের অঙ্গ, নিজের টিস্যু পর্যন্ত আক্রমণ করে বসে।
সাকাগুচির এই আবিষ্কারকে আরও শক্ত ভিত্তি দেন মেরি ব্রানকো এবং ফ্রেড র্যামসডেল। তারা ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে দেখেন, কিছু ইঁদুরের শরীরে স্কারফি নামে এক ধরনের গুরুতর অটোইমিউন রোগ দেখা দিচ্ছে, যার কারণ খুঁজতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করেন এক্স ক্রোমোজোমে থাকা একটি বিশেষ জিনÑ ফক্সপি৩ (FoxP3)। এই জিনে ত্রুটি ঘটলেই সেই ইঁদুরের শরীরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। মানুষের মধ্যেও যাদের ফক্সপি৩ জিনে ত্রুটি আছে, তাদের মধ্যে দেখা যায় আইপেক্স (IPEX) নামের এক বিরল রোগ, যা শিশুদের জীবনের প্রথম কয়েক বছরেই প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। সাকাগুচি দেখালেন, এই ফক্সপি৩ জিনই আসলে সেই নিয়ন্ত্রণকারী টি-সেল তৈরির মূল চাবিকাঠি। অর্থাৎ এই জিনই ঠিক করে দেয় শরীর কতটা সহনশীল হবে নিজের প্রতি। এ যেন দেহের অভ্যন্তরে এক প্রকার আত্মসংযমের শিক্ষা।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এই গবেষণাগুলো মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা আসলে দুটি বিপরীত শক্তির ভারসাম্যে টিকে আছেÑ একদিকে আক্রমণ, অন্যদিকে সংযম। ঠিক যেমন সমাজে থাকে আইন ও স্বাধীনতার ভারসাম্য। অতিরিক্ত স্বাধীনতা থেকে যেমন বিশৃঙ্খলা আসে; আর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণে দম বন্ধ হয়ে যায়। শরীরও একই নিয়মে চলে। তাই বলা যায়, এই আবিষ্কার শুধু চিকিৎসার নয়, জীবনবিজ্ঞানের দার্শনিক স্তরেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।
আজকের দিনে এই গবেষণার প্রয়োগও দেখা যাচ্ছে নানা চিকিৎসায়। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা করছেন শরীরে রেগুলেটরি টি-সেলের সংখ্যা বাড়িয়ে অটোইমিউন রোগ প্রতিরোধ করতে। আবার বিপরীতভাবে ক্যানসার চিকিৎসায় এই কোষগুলোর কার্যক্ষমতা কমিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে, কারণ অনেক ক্যানসার কোষ রেগুলেটরি টি-সেলকে ব্যবহার করে নিজেদের রক্ষা করে। অর্থাৎ একদিকে এই কোষ জীবন রক্ষা করে, অন্যদিকে কিছু ক্ষেত্রে জীবননাশের কারণও হতে পারে। তাই এখন চিকিৎসা গবেষণার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে এই সূক্ষ্ম ভারসাম্যকে বোঝা ও নিয়ন্ত্রণ করা।
নোবেল অ্যাসেম্বলির ঘোষণার দিন এক মজার ঘটনা ঘটে। সংগঠনের সচিব জেনারেল থমাস পার্লমান বলেছিলেন, তিনি তিনজন বিজয়ীর মধ্যে কেবল শিমন সাকাগুচির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন। বাকিদের ফোন তখন সাইলেন্ট মোডে ছিল। শুনে সবাই হেসেছিল, কিন্তু এ যেন এক প্রতীকী দৃশ্যÑ এই মানুষগুলোই সত্যিকারের নীরব নায়ক, যাদের জীবন আলোয় নয়, ছায়ায় কেটেছে। তারা করতালির জন্য কাজ করেননি; তারা আসলে মানবিক তাগিদে জানতে চেয়েছিলেন মানুষের শরীর কেমন করে নিজের ভুল সংশোধন করে।
তাদের এই কাজ আজ নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক বড় চ্যালেঞ্জ, যেমন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর শরীরের প্রত্যাখ্যান প্রতিক্রিয়া বা অটোইমিউন রোগের চিকিৎসাÑ সবখানেই এই আবিষ্কার থেকে নতুন দিকনির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে। বহু ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে, যেখানে রোগীর শরীরে রেগুলেটরি টি-সেল বাড়িয়ে অপ্রয়োজনীয় ইমিউন প্রতিক্রিয়া থামানোর চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে ক্যানসার চিকিৎসায় ঠিক উল্টোভাবে এই কোষগুলো দুর্বল করে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হচ্ছে, যাতে তা ক্যানসার কোষকে আক্রমণ করতে পারে। একদিকে এই কোষ আমাদের রক্ষা করে, অন্যদিকে প্রয়োজনে তা নিয়ন্ত্রণ করেও জীবন বাঁচায়Ñ এ যেন বিজ্ঞানের সবচেয়ে সুন্দর বৈপরীত্য।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
তিন বিজ্ঞানীর কাজ প্রমাণ করেছে, প্রকৃত জ্ঞান সব সময়ই নিঃস্বার্থ এবং মানবিক। তারা দেখিয়েছেন, মানুষের শরীর যেমন নিজের মধ্যে ভুল বুঝে তা সংশোধন করতে পারে, তেমনি সভ্যতাও পারে, যদি আমরা নিজের অহংকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যখন রাজনীতি মানুষকে বিভক্ত করছে, তখন গবেষণাগারে বসে কিছু মানুষ দিনরাত এক করে যাচ্ছেন মানুষকে একত্র করার কাজÑ রোগমুক্তির নামে, জীবনের আশায়। এটাই সভ্যতার আসল দিকনির্দেশনা।
একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে যখন এই খবর পড়ি, তখন প্রশ্ন জেগেছেÑ মানুষ এত প্রতিভাবান হয় কীভাবে? আসলে প্রতিভা কেবল মেধা নয়, এটি অধ্যবসায় ও কৌতূহলের ফল। এই তিনজন বিজ্ঞানী একসঙ্গে প্রমাণ করেছেন, আবিষ্কার মানে শুধু নতুন কিছু জানা নয়, বরং পুরনো ধারণাকে নতুন চোখে দেখা। তারা দেখিয়েছেন, শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাও কেবল যুদ্ধ নয়, শান্তির কৌশল জানে। এটি শত্রু ধ্বংস করে, কিন্তু নিজের ওপর আক্রমণ কখন থামাতে হবে তাও জানে। এই থামার ক্ষমতাই জীবনকে টিকিয়ে রাখে।
আজ যখন বিশ্বজুড়ে মানুষ রাজনীতির উত্তাপে ক্লান্ত, তখন এই ধরনের বৈজ্ঞানিক সাফল্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সভ্যতা এখনও বেঁচে আছে কারণ বিজ্ঞান বেঁচে আছে। কেউ অস্ত্র দিয়ে নয়, জ্ঞান দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করছে। সাকাগুচি, ব্রানকো ও র?্যামসডেল সেই অদৃশ্য যোদ্ধা, যাদের যুদ্ধক্ষেত্র হলো মাইক্রোস্কোপের নিচে আর শত্রু হলো এক অজানা কোষ। তাদের প্রতিটি আবিষ্কার মানুষের জীবনকে একটু বেশি নিরাপদ, একটু বেশি অর্থপূর্ণ করে তুলছে।
এ বছর তারা পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন একটি স্বর্ণপদক, সনদপত্র এবং প্রায় ১৪ কোটি ১৬ লাখ টাকার (১২ লাখ মার্কিন ডলার) চেক। কিন্তু তাদের অবদানের মূল্য কোনো অর্থে মাপা যায় না। তারা আমাদের শেখালেন, বিজ্ঞান কেবল জ্ঞান নয়, এটি মূলত কল্যাণেরই ভাষা। নিজের শরীরের সহনশীলতা বুঝে নেওয়া মানে অন্যের প্রতি সহনশীলতা শেখাও বটে। তাই শুধু অভিনন্দন নয়, টুপিখোলা শ্রদ্ধা তাদের প্রাপ্য। কারণ সভ্যতা বেঁচে আছে তাদের মতো মানুষের হাতেইÑ যারা নীরবে, অবিরাম, মানবতার সেবায় নিবেদিত থেকে পৃথিবীকে একটু বেশি মানবিক বোধসম্পন্ন করে তুলছেন।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক
মতামত লেখকের নিজস্ব