শহরের দেয়ালে পোস্টারের সংস্কৃতি

অদ্রিতা দাস
০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৬
শেয়ার :
শহরের দেয়ালে পোস্টারের সংস্কৃতি


যানজট, কোলাহল, হর্নের আওয়াজ, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা ফেরিওয়ালার হাঁকÑ এ হলো বাংলাদেশের শহরগুলোর নিত্যদিনের প্রতিচ্ছবি। শহরের এই ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিনিয়তই আমাদের নজর কেড়ে নেয় দেয়ালে এঁটে থাকা নানা বৈচিত্র্যের পোস্টার। কখনও রাজনৈতিক নেতার মুখ, আবার কখনও পণ্যের বিজ্ঞাপনই যেন শহরের দেয়ালগুলোর মুখের ভাষা হয়ে উঠেছে, যেখানে ফুটে ওঠে সমাজ, রাজনীতি ও বাণিজ্যের রঙিন প্রতিযোগিতা। কিন্তু পোস্টারের এই সংস্কৃতি কি আদৌ শহরের পরিবেশকে রঙিন করে তোলে, নাকি এটি কেবল দৃষ্টিদূষণের আরেক নাম?

পোস্টার একটি বহুল প্রচলিত প্রচারমাধ্যম। কিন্তু পোস্টারকে প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা সেদিনকার কথা নয়; বরং এর ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৪৪০ সালে জোহান গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর থেকে লিখিত ও চিত্রভিত্তিক প্রচারণা সহজ হয়। তবে পোস্টার তৈরিতে বিপ্লব ঘটে ১৯০০ শতকের শেষে খরঃযড়মৎধঢ়যু প্রযুক্তির আবিষ্কারের পর থেকে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ বিভিন্ন স্বাধীনতা আন্দোলন, নারী অধিকার, শ্রমিক অধিকার আদায়ে পোস্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে। পোস্টার মানুষের মনে জাগ্রত করে দেশপ্রেম এবং গড়ে তোলে সচেতনতাবোধ। তবে আমরা এখন যখন রাস্তায় বের হয়েই হাজারটা রাজনৈতিক নেতার মুখ দর্শন করি, তা কখনও কখনও সচেতনতা তৈরির বদলে বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। শুধু রাজনৈতিক কিংবা বিজ্ঞাপনের পোস্টারই নয়, বিভিন্ন চলচ্চিত্রের অরুচিকর পোস্টার যেন শহরের দেয়ালগুলোর প্রতিদিনের সঙ্গী। দেয়ালের বাইরেও দোকানের শাটার, রাস্তার ধারের বৈদ্যুতিক খুঁটি এমনকি বাড়ির দরজায়ও দেখা যায় বিভিন্ন পোস্টারের সমাহার। বিশেষ করে নির্বাচনকালে প্রচারণার জন্য পোস্টারের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। এখন আবার নতুন করে দৃষ্টি টানে স্কুল-কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনের পোস্টার বিতরণকার্য। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ এত এত পোস্টারের শেষ আশ্রয়স্থল কোথায়? এর উত্তর হিসেবে বলা যায়, বেশির ভাগ দেয়াললিপিই পড়ে থাকে নর্দমা কিংবা জলাশয়ে, যার কারণে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতাসহ আরও নানা সমস্যা। তা ছাড়া পোস্টারে ব্যবহৃত সলভেন্টভিত্তিক কালি কিংবা পেট্রোলিয়ামনির্ভর কালি আমাদের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে দেয়ালিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইন অনুযায়ী দেয়ালে পোস্টার লাগানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যাদের দ্বারা এই আইন বাস্তবায়ন হওয়া উচিত সেসব রাজনীতিবিদই অসংখ্য পোস্টার ছাপিয়ে আইন লঙ্ঘনের জন্য জনসাধারণকে উসকে দেন। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, আইনটি প্রণয়নের এক দশক পরও এটি কার্যকর ছিল না। ২০২৩ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) আইন বাস্তবায়নের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এবং যত্রতত্র পোস্টার লাগালে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ থাকে। কিন্তু সার্বিকভাবে বলা যায়, আইনের প্র?য়োগ না থাকার কারণে ২০১২ সালের আগের চেয়ে পরে দেয়ালে পোস্টার লাগানোর হার আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

পোস্টার সংস্কৃতি আমাদের সামাজিক ইতিহাসের একটি অংশ হলেও বর্তমানে শহরের সৌন্দর্য নষ্টের একটি বড় কারণ হলো এই পোস্টার। আধুনিক যুগে সবকিছুই যেহেতু অনলাইলের মাধ্যমে করা হচ্ছে তাই পোস্টার ছাপানোর পরিবর্তে অনলাইনকে কাজে লাগিয়ে প্রচার-প্রচারণা করা অসম্ভব কিছু নয়। এমনকি এখন অনেক সচেতন নাগরিক বিকল্প হিসেবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, ব্যানার ও অনলাইন বিজ্ঞাপন ব্যবহার করছেন। এই পরিবর্তনই প্রমাণ করে, প্রযুক্তি এখন পরিবেশবান্ধব প্রচারের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।


অদ্রিতা দাস : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়


মতামত লেখকের নিজস্ব