জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন
থমকে যাচ্ছে শিল্পায়ন
দেশের শিল্পোন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি জ্বালানি সরবরাহ। অথচ সেই ভিত্তিই এখন সবচেয়ে নড়বড়ে অবস্থায়। দেশের বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকের প্রতিদিনের গ্যাসের চাহিদার চার ভাগের এক ভাগও মেলে না নিজস্ব উৎস থেকে। বাকি অংশ পূরণ করতে হয় আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) দিয়ে, যা ব্যয়বহুল এবং বৈশ্বিক বাজারদরের ওপর নির্ভরশীল। এই বাস্তবতা কেবল সাময়িক সংকটের সংকেত নয়, এটি আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য গভীর সতর্কবার্তা।
২০১০ সালে শিল্প খাতে গ্যাসের দাম ছিল প্রতি ঘনমিটার ৬ থেকে ১২ টাকার মধ্যে; আবাসিক পর্যায়ে ডাবল বার্নার গ্যাসের দাম ছিল মাত্র ৪০০ টাকা। বর্তমানে সেই দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে শিল্পে ৪০ টাকা, ক্যাপটিভে ৪২ টাকা এবং আবাসিকে ১ হাজার ৮০ টাকা। অথচ এই দামেও সরকার ভর্তুকির বোঝা থেকে মুক্ত নয়। বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজির প্রকৃত মূল্য প্রতি ঘনমিটার ৬৮ টাকার বেশি। ফলে স্থানীয় গ্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে কম দামে সরবরাহ করতে গিয়ে পেট্রোবাংলাকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সস্তায় জ্বালানি পেয়ে বাংলাদেশ একসময় যে শিল্পবিপ্লবের পথে এগিয়েছিল, এখন সেই ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় শিল্প মালিকদের ক্ষোভও অযৌক্তিক নয়। তারা বলছেন- গ্যাসের দাম বারবার বাড়ছে, কিন্তু সরবরাহ নিশ্চিত হচ্ছে না। ফলে রপ্তানি ও বিনিয়োগে বাধা তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে আসছেন, বাংলাদেশকে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ উৎসে গ্যাস অনুসন্ধান বাড়াতে হবে। অথচ বাস্তবে বিগত সরকারগুলো বেশি মনোযোগ দিয়েছে আমদানি ও টার্মিনাল নির্মাণে। এলএনজি আমদানির সক্ষমতা বাড়াতে নতুন নতুন টার্মিনালের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাকসিলারেট এনার্জির সঙ্গে সরকারের নতুন চুক্তি তারই উদাহরণ। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক মুদ্রার চাপ আরও বাড়বে- এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।
তবে সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি নীতিগতও। টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা মানে কেবল বিদেশ থেকে জ্বালানি কেনা নয়, বরং নিজস্ব সম্পদে নির্ভরতা তৈরি করা। বাপেক্স, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি, সিলেট গ্যাস ফিল্ডের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত সম্পদ ও সক্ষমতা নিয়েও কিছু গ্যাস উৎপাদন করছে। তাদের আরও সুযোগ ও প্রযুক্তি সহায়তা দিতে হবে। অনুসন্ধান, খনন ও উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু পুরো ব্যবস্থাকে আমদানিনর্ভর করে তোলা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মুহূর্তে গ্যাসসংকট নিরসনে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি দুটি ধাপে পদক্ষেপ জরুরি। বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলো পুনর্মূল্যায়ন ও উৎপাদন বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করতে হবে।
নতুন অনুসন্ধান ব্লক খুলে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে স্বচ্ছ নীতিমালার মাধ্যমে।
এলএনজি আমদানির পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিতে হবে, বিশেষ করে সৌর ও বায়ু শক্তিকে শিল্প খাতে সংযুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এ ছাড়া গ্যাস অপচয় রোধ, পাইপলাইনের আধুনিকায়ন ও শিল্পে গ্যাস সরবরাহে অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়ন জরুরি।
একটি দেশের শিল্পায়ন তখনই টেকসই হয়, যখন জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় গ্যাস এখন কেবল জ্বালানি নয়, শিল্প ও অর্থনীতির প্রাণরস। সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে শিল্প, বিনিয়োগ, এমনকি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাও চাপে পড়বে। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো কোনো স্থায়ী সমাধান নয়; বরং নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগই এখন জরুরি।
দেশে যে গ্যাস আছে, তা যথাযথ ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি ও স্বচ্ছ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। একই সঙ্গে জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে কোনো সরকারের পরিবর্তনে নীতি পরিবর্তন না হয়। আমদানিনির্ভরতার শৃঙ্খল ভেঙে জ্বালানি নিরাপত্তার স্থায়ী ভিত্তি গড়তে না পারলে বাংলাদেশের শিল্পায়নের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে পড়বে। এখনই সময় নিজস্ব সম্পদের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে এনে টেকসই জ্বালানিনীতির পথে এগিয়ে যাওয়ার।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২