শিক্ষা সংস্কারে চাই সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা আজ আর আড়ালে রাখার মতো কোনো বিষয় নয়; বরং এটি আমাদের জন্য একটি নগ্ন বাস্তবতা, যা প্রতিনিয়ত জাতির ভবিষ্যৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার ‘দ্য রিপাবলিক’-এ শিক্ষার লক্ষ্যকে রাষ্ট্র গঠনের মূলভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় কেবল জনপ্রিয় স্লোগান দেওয়া বা সাময়িক সংকট ঠেকানো, তবে তার ফল হবে লেবাসধারী ও অস্থায়ী। রাজনৈতিক ফয়দা হাসিলের জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই ভ্রান্তি বহু দশক ধরে চলে আসছে। সরকার পরিবর্তনে প্রতিবার নীতি পরিবর্তন, কাঠামোগত সংস্কার কিংবা নতুন পরামর্শকের নিয়োগ কেবল রাজনৈতিক সুবিধা বা তাৎক্ষণিক তুষ্টির জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ প্রকৃত সংস্কারের জন্য প্রয়োজন সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ, জরুরি ও স্বল্পমেয়াদি সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি মধ্যমেয়াদি রূপকল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। অন্যথায় শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ রূপান্তর করে আমরা যে ‘বৈষম্যহীন’ ও ‘স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশা করি, তা কখনই পূর্ণতা পাবে না।
২০১২ সালের শিক্ষাক্রম যেভাবে হুট করে বাতিল করা হয়েছিল, তেমনি বর্তমানে বিদ্যমান শিক্ষাক্রমও একই পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। এ ধরনের একক সিদ্ধান্তনির্ভর আচরণ শিক্ষার সংস্কৃতিতে একটি দুষ্টচক্রের জন্ম দিয়েছে, যা শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার বদলে দিন দিন আরও দুর্বল করে তুলেছে। শিক্ষা সংস্কার তখনই ফলপ্রসূ হয়, যখন তা দীর্ঘ আলোচনার মধ্য দিয়ে, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের মতামত নিয়ে, বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের দেশে সংস্কারের নামে বারবার জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের খাতিরে, অর্থাৎ তাৎক্ষণিক জনতুষ্টির লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর ফলে শিক্ষানীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে পরীক্ষামূলক এক ল্যাবরেটরি, যেখানে শিক্ষার্থীরা বারবার অকার্যকর ও অস্থায়ী পরীক্ষার শিকারে পরিণত হয়েছে।
আমাদের নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন কোনো ‘চটপট’ (শর্টকাট) প্রক্রিয়া নয়। এর জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিকতা, বিচক্ষণতা, দৃঢ়তা এবং কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস। জনমোহন সিদ্ধান্ত যেমন তাৎক্ষণিক স্বস্তি এনে দেয়, তেমনি দীর্ঘ মেয়াদে তা দেশ ও জাতির জন্য সর্বনাশ ডেকে আনে। বাস্তবে যেকোনো রোগ সারাতে হলে অনেক সময় তিতা ওষুধ গিলতে হয়। তাই বলে এই প্রাচীন সত্যটি উপেক্ষা করলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও তাই সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য যদি আমরা তিক্ত বাস্তবতা মেনে না নিতে পারি, তবে সংস্কারের নামে আবারও নতুন ব্যর্থতার বীজ বপন করা হবে। পাশাপাশি আমাদের এটাও মনে রাখা জরুরি যে, বারবার নীতিগত উলটপালট শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকেই বিপর্যস্ত করছে না, বরং পুরো সমাজকে এক অনিশ্চয়তা, এমনকি বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ভূমিকা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে, শিক্ষকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন, আর শিক্ষার্থীরা আস্থা হারিয়ে হচ্ছে বিভ্রান্ত ও দিশাহারা। এই অনিশ্চয়তা কেবল শিক্ষাব্যবস্থাকেই নয়, রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
মূলধারার সাধারণ শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়েও বিতর্ক রয়ে গেছে। এটি কি কেবল বিশেষ কাজের বা পেশাভিত্তিক দক্ষতা অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিস্তৃত মানবিক চেতনা, সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িত্বশীল নাগরিকত্ব গঠনে কাজ করবে? বিশ্বের উন্নত শিক্ষাব্যবস্থাগুলো দেখিয়েছে যে, কেবল শ্রমবাজারের জন্য দক্ষতা নয়, বরং সৃজনশীল, সমস্যা সমাধানে সক্ষম ও নৈতিক মানুষ তৈরি করাই শিক্ষানীতির কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত। মোতাহের হোসেন চৌধুরী তার কালজয়ী ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে শিক্ষার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, শিক্ষার কাজ কেবল পেশার প্রস্তুতি নয়, বরং মানুষকে পূর্ণ মানুষ করে তোলা। আজকের নীতিনির্ধারকদের সেই দিকনির্দেশনার আলোকে নিজেদের অবস্থান নতুন করে পর্যালোচনা করা অপরিহার্য। পাশাপাশি শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিন দার্শনিক জন ডিউইয়ের কথা মনে রাখা যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা হলো সমাজের পুনর্গঠনের প্রধান হাতিয়ার। যদি শিক্ষা শুধুই চাকরির প্রস্তুতিমূলক হয়, তবে সমাজ থাকবে স্থবির ও সংকীর্ণ। আর যদি শিক্ষা মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখায়, তবে সেই সমাজে জন্ম নেবে সৃজনশীলতা, মানবিকতা, সমতা এবং ন্যায়বোধ। সুতরাং, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য নির্ধারণে নীতিনির্ধারকদের সামনে এখন দুটি পথ খোলা রয়েছে- হয় সংকীর্ণ দক্ষতা সরবরাহে আটকে থাকা, নয়তো বিস্তৃত মানবিক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি রচনা করা।
প্রায়োগিক অর্থে একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সেই দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। অথচ আমাদের দেশে বর্তমানে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বড় সংকট হলো চাহিদা ও জোগানের মধ্যে গুরুতর অমিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তরুণদের মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনার প্রতি বিপুল আগ্রহ থাকলেও দেশে চিকিৎসা কলেজে আসনসংখ্যা সীমিত। এর ফলে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ দেশের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তারের সংকট দীর্ঘদিন ধরেই প্রকট; গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলে চিকিৎসক সংকট যেন এক অব্যাহত অভিশাপ। অন্যদিকে এলাকাভেদে রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বল্পমেয়াদি জনপ্রিয়তার খাতিরে অকারণে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে, যেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষক, গবেষণাগার কিংবা অবকাঠামোগত সক্ষমতা নেই। ফলে একদিকে সম্পদের অপচয় ঘটছে, অন্যদিকে জাতীয় প্রয়োজন মেটানো যাচ্ছে না। উন্নয়ন অর্থনীতির গবেষণাগুলো বারবার প্রমাণ করেছে- যেখানে শিক্ষা পরিকল্পনা শ্রমবাজারের বাস্তব চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সেখানে শিক্ষিত বেকারত্ব অনিবার্যভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশও এখন সেই সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, স্নাতক ডিগ্রিধারীদের একটি বড় অংশ উপযুক্ত কর্মসংস্থানের বাইরে থেকে যাচ্ছে, অথচ বিশেষ খাতগুলোতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করছে।
এই বৈসাদৃশ্য কেবল ব্যক্তিগত হতাশা নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির জন্যও এক গভীর হুমকি। যুবসমাজ যখন সনদধারী শিক্ষিত হয়েও বেকার থাকে, তখন তা সামাজিক অস্থিরতা, মেধাপাচার ও রাজনৈতিক অশান্তি বাড়িয়ে তোলে। ইতিহাসে দেখা গেছে, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই শিক্ষা পরিকল্পনার এই ভুলে দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও সামাজিক অস্থিরতার শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের সামনে এখন একই ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। তাই মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে সঠিক শিক্ষা পরিকল্পনা ও শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া উন্নয়নের টেকসই পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো শিক্ষাসংক্রান্ত দপ্তর ও অধিদপ্তরগুলোতে যোগ্য ও দূরদর্শী মানুষকে দায়িত্বে বসানো। বিশেষ করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) বারবার মন্ত্রণালয়ের টানাপড়েন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ভাঙচুর না করে বরং এটিকে একটি শক্তিশালী ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা অপরিহার্য। যোগ্যতার ভিত্তিতে দক্ষ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতে হবে, যারা পরিকল্পনা, শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, শিক্ষাদান পদ্ধতির আধুনিকীকরণ, মূল্যায়নসহ সবকিছুকে সমন্বিতভাবে বুঝে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবেন। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা দিয়ে কাউকে ‘পাঠদান পদ্ধতির বিশেষজ্ঞ’ (পেডাগজি এক্সপার্ট) বানিয়ে দেওয়া চলবে না। শিক্ষাবিদ মানে কেবল বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানদাতা নন, বরং এমন একজন জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি যিনি শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, দর্শন, নীতি, প্রয়োগ এবং মূল্যায়ন সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা রাখেন এবং সেসবের বাস্তবে প্রয়োগে অভিজ্ঞ।
একই সঙ্গে মনে রাখা জরুরি যে, পরিকল্পনার শক্তি শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ নয়; তার কার্যকারিতা নির্ভর করে সঠিক বাস্তবায়নের ওপর। তাই সমন্বিত শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পাশাপাশি কার্যকর মূল্যায়ন পদ্ধতি, পর্যাপ্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং অবকাঠামোগত সহায়তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। না হলে পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নের পথে শিক্ষাব্যবস্থা বারবার হোঁচট খাবে।
বাস্তবতা হলো, আজকের বিশ্বে শিক্ষা কেবল পাঠ্যপুস্তক ও শ্রেণিকক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা হয়ে উঠেছে বহুমাত্রিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতিমূলক। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতেও নতুন দিকদর্শনের প্রয়োজন। যদি নীতিনির্ধারকরা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এগিয়ে আসেন, শিক্ষার উদ্দেশ্যকে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেন, পরিকল্পনায় স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যকে সমন্বিত করেন এবং সর্বোপরি জনস্বচ্ছতা বজায় রাখেন, তবে শিক্ষা সংস্কার কার্যকর রূপ পাবে। অন্যথায় আমরা পুরনো কাঠামোর ভেতরে নতুন সমস্যার ভার চাপিয়ে শিক্ষাকে আরও জটিল করে তুলব। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শুধু আকাক্সক্ষা নয়, টিকে থাকার পূর্বশর্ত। ‘বৈষম্যহীন’ ও ‘স্বৈরাচারমুক্ত’ একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র পুনর্গঠনের যে স্বপ্ন ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা জাতির সামনে এনেছিল, শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমেই তার বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব। এ জন্য দরকার যোগ্য শিক্ষাবিদ, দূরদর্শী পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সামাজিক অংশগ্রহণ। তাই শিক্ষা সংস্কারে লুকোচুরি নয়, চাই সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প। তাহলেই অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে একটি জ্ঞানসমৃদ্ধ, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে পারবে।
ড. মাহরুফ চৌধুরী : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?
মতামত লেখকের নিজস্ব