সংগঠক, উদ্যোক্তা ও পরার্থপর আহমদ রফিক
ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের (১৯২৯-২০২৫) প্রয়াণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ত্রিকালদর্শী কর্মী-লেখক-সংগ্রামীর জীবনের সমাপ্তি ঘটল। তাকে আমি ত্রিকালদর্শী বলতাম এই কারণে যে, পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার। তরুণ বয়সের শুরুতেই কীভাবে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার নামে দেশকে আরেকবার পরাধীনতার গ্লানি বরণ করতে হয়, সেই বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা মামুলি নয়, দ্রষ্টার মতো। আর একাত্তরে স্বাধীনতার লড়াই যখন রক্তক্ষয়ী এক জনযুদ্ধে পরিণত হয়, তারও প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। বিপন্ন ঢাকায় অতি গোপনে মুক্তিকামী অনেকের করেছেন চিকিৎসার বন্দোবস্ত, বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তারও নানা বন্ধুরতা প্রত্যক্ষ করে গেলেন তিনি। ব্যক্তিজীবনের চেয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ ভাবনা, ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে সমষ্টি ও শোষিত শ্রেণির মুক্তির ভাবনা তাকে বেশি কাতর করে তুলত। যে কারণে ব্যক্তিগতভাবে সঞ্চয়ের প্রতি তার মোহ ছিল না। সুযোগ পেলেই সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য গঠনমূলক কর্মতৎপরতায় নেমে পড়েছেন। তার পরার্থপর প্রবণতার কারণেই তিনি ছাত্রজীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েন বামপন্থি রাজনীতি ও সাহিত্যচর্চার সঙ্গে। যেকোনো কাজে তিনি প্রাধান্য দিতেন একনিষ্ঠতা ও সততাকে। সেই নিষ্ঠতার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৫৩ সালেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এ সময় বন্ধু আলীম চৌধুরী সম্পাদিত যাত্রিক ও জহির রায়হানের প্রবাহ পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত হন। তার আত্মমূল্যায়ন হলো, ‘রাজনীতি ও সাহিত্য গ্রাস করে মেধাবী মেডিক্যাল ছাত্র রফিককে।’ তার স্বপ্ন ছিল আধুনিক একটা সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার। সেই স্বপ্নপ্রকল্প হিসেবে প্রকাশ করেন নাগরিক (১৯৬২-১৯৭০) নামের সাহিত্য পত্রিকা। ‘বাঙালির জাতীয় শিল্পোদ্যোগের প্রকাশ হিসেবে’ ১৯৬৪ সালে ছয় বিত্তবান বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয় স্বপ্নপ্রকল্প হিসেবে গড়ে তোলেন ‘ওরিয়ন ল্যাব’। ছিলেন চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। কিন্তু অর্থনৈতিক লেনদেনের পূর্ণ ক্ষমতা ছিল এমডির হাতে। তার ভাষ্য, কোম্পানির ‘বাস্তব অর্থ সবরাহকারী এমডির হাতে’ থাকায় এর নৈতিক বিপর্যয় ঠেকানো যায়নি। তাই তিনি পদত্যাগ করেন; শূন্যহাতে। আশির দশকে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বায়োপ্যাথ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। কয়েক বছর চলার পর সেটিও বন্ধ করে দিতে হয় ‘বিশেষজ্ঞ কয়েকজন চিকিৎসকের অসহযোগিতার কারণে’।
তবে এ সময় বাংলাদেশের ওষুধনীতি প্রণয়নে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর একতরফা নীতির বিরুদ্ধে সামনের সারিতে থেকে লড়াই করে দেশের ওষুধনীতির পক্ষে ব্যাপক সমর্থক আদায় করেন। এ সময় অগ্রণী ভূমিকায় থাকার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেছেন, ‘অনেক বাধা ও প্রতিকূলতার মুখেও ওষুধনীতি প্রণীত হয়। জনবান্ধব এ নীতির প্রতি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যমহলের স্বীকৃতি ও প্রশংসা লাভ করে।’ ১৯৮৯ সালে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার ব্যয় তিনি নিজেই নির্বাহ করে গেছেন। এ সময় তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি যেন তাদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের উদ্যোগ ও আয়োজনে তিনি ঢাকা ও কলকাতায় চারটি করে রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন সম্পন্ন করেন। এসব আয়োজনে তিনি তরুণ গবেষকদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেন। এসবের ব্যয় ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় নির্বাহ করেছেন। এই কেন্দ্রর জন্য একটি স্থায়ী ঠিকানার খুব প্রয়োজন ছিল। স্বৈরাচারী বলে এরশাদ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাখ্যান করেন নীতি ও আদর্শে অটল আহমদ রফিক। কিন্তু পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে আবেদন করেও রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের জন্য কোনো পৃষ্ঠপোষকতা তিনি পাননি। ফলে তিনি এর নানা ধরনের ব্যয় যখন আর নির্বাহ করতে পারেননি, তখন থেকে এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে হতাশার কথা বলেছেন।
এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৮৩ সালে তিনি একুশের চেতনা পরিষদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। কয়েক বছর ধরে একুশে সম্মেলন আয়োজন করা হয় সংগঠনটি থেকে। সব শেষে, বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ২০১৭ সালে রুশ বিপ্লবের শতবার্ষিক আয়োজনে অন্যতম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এভাবেই প্রায় সারাজীবন তিনি নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন।
দুই.
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
দীর্ঘ জীবনপ্রাপ্তি যে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য আশীর্বাদ। আহমদ রফিক তার দীর্ঘ জীবনে সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধকরণে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেছেন। আমার সুযোগ হয়েছে জীবনভর কর্মী-সংগ্রামী ও লেখক আহমদ রফিকের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যপ্রাপ্তির। আমার মূল্যায়ন, তিনি একজন নির্মোহ, অবৈষয়িক ও নির্বিরোধ মানুষ ছিলেন। ফলে পত্রিকায় লেখা কলাম, সাহিত্য পর্যালোচনা, গবেষণা, জীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা, প্রভৃতি যেকোনো রচনায় তিনি থাকতেন নৈর্ব্যক্তিক। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তিনি অনেক গ্রন্থ প্রণয়ন করলেও কখনও নিজেকে তিনি সামনে আনেননি; রেখে দিয়েছেন আড়ালে।
আত্মত্যাগী এই মানুষটি যখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেছেন, শরীরে নানা অসুখ বাসা বেঁধেছে, তখন অশীতিপর বয়সে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র-সাহিত্য গবেষণার জন্য ট্রাস্ট গঠনে আর্থিক অনুদান প্রদান করেছেন। জীবনের শেষদিকে, বিশেষত ২০১৯ সাল থেকে যখন তার অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, তখনই জানতে পারি, তার আবাসস্থলটি তার নিজের নয়, ভাড়া। নিজের সম্পদ বলতে তার তেমন কিছু নেই। ব্যাংকে যা আছে, তা-ও কোনো লাভজনক স্কিমে (এফডিআর, সঞ্চয়পত্র) বিনিয়োগ করা নয়। সম্পদ বলতে নিজের লেখা প্রকাশিত শতাধিক গ্রন্থ, নিজের সংগৃহীত কিছু দুর্লভ গ্রন্থ, ঘরের খুব সাধারণ কিছু আসবাব, পত্রপত্রিকা, পদক ইত্যাদি (যা তিনি তার মৃত্যুর পর ‘ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ফাউন্ডেশন’কে দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন)।
আরও জানতে পারি, আর্থিক সচ্ছলতা থাকাকালে বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি নিঃস্বার্থভাবে উদার হস্ত প্রসারিত করা ছিল তার পুরনো অভ্যাস। এর মধ্যে অনেকেই ছিলেন সুযোগসন্ধানী। তার সারল্য বুঝতে পেরে ‘অসহায়ত্বের ভান’ করে তার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। এসব বিষয়ে কথা বলতে তিনি অনাগ্রহী ছিলেন। কখনও বা কথা উঠলেও ছিল তার সহজ স্বীকারোক্তি, তার পরিবারের সদস্যদের যে গড় আয়ু, সে অনুযায়ী তার তো এত দিন বেঁচে থাকার কথা নয়। যেহেতু তার কোনো উত্তরাধিকারী নেই, সেহেতু অর্থকড়ি কারও জন্য রেখে যাওয়ার বাধ্যবাধকতাও নেই। কিন্তু ২০২১ সালে সঞ্চয় প্রায় যখন শেষ হয়ে আসে, শারীরিক অসুস্থতা যখন জেঁকে বসে নানা দিক থেকে, তখন তার অনুমতি নিয়ে পত্রিকায় লিখি, ‘উপার্জনহীন জীবনে দরকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা’। সেই সময় থেকে তাকে নিয়ে আমার লেখা নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। ফলে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তার পাশে এসে দাঁড়ায়। বিশেষত, ২০২২ সালের পর নিঃসঙ্গ এই মানুষটির জীবনের ব্যয় নির্বাহ হয়েছে মূলত সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহযোগিতায়। আমরা পাশে থেকে উপলব্ধি করেছি, এমন নিঃসহায় জীবন তিনি চাননি।
তিন.
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
কোভিডকালেও তিনি আমাদের সান্নিধ্য চাইতেন। প্রথম প্রথম না গেলেও পরে গেছি। ভীষণ ভয় ও আশঙ্কা নিয়ে গিয়ে বসতাম ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে’। কিন্তু সেটা মানতে চাইতেন না। চাইতেন স্বাভাবিকভাবে কাছে গিয়ে বসি। সেই সময় কেবল দুশ্চিন্তায় ছিলেন চোখের পীড়া নিয়ে। চোখের পীড়ার কারণে শেষদিকে তিনি মানসিকভাবে কিছুটা হতাশাগ্রস্ত এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। পড়তে এবং লিখতে না পারার বেদনা তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে কাবু করে ফেলেছিল।
এক যুগেরও বেশি সময় ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের সান্নিধ্য পাওয়ার সুবাদে বলতে পারি, ‘কালাম’ ও ‘জাহানার মা’ নামের দুজন মানুষ ছিলেন তার স্বজনের অধিক স্বজন। তাদের সার্বক্ষণিক যত্নেই থাকতেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা না জানা দুজনই একবার দেখিয়ে দিলে, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী নির্ভুলভাবে তাকে ওষুধ সেবন করাতেন। তাদের মধ্যে কালাম ৩৬ বছর ধরে এবং জাহানার মা আছেন ২৫ বছর ধরে। এই দুজন রক্ত-সম্পর্কহীন স্বজনই ছিলেন তার শেষ ভরসা। তাদের ছিল আহমদ রফিকের জন্য অফুরন্ত দরদ।
ড. ইসমাইল সাদী : সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত লেখকের নিজস্ব
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!