স্থবির প্রকল্পে শৃঙ্খলা ফিরুক

বিলাসী ভবন প্রকল্প

সম্পাদকীয়
০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
স্থবির প্রকল্পে শৃঙ্খলা ফিরুক

রাষ্ট্রীয় তিন তেল বিপণন কোম্পানি- পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা এক যুগ আগে নিজস্ব ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল আধুনিক অফিস গড়ে তোলা, আয় বাড়ানো ও প্রশাসনিক দক্ষতা নিশ্চিত করা। কিন্তু এক দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পগুলোর একটি ভবনও সম্পূর্ণ হয়নি। বরং সময় যত গেছে, ব্যয় তত বেড়েছে, কিন্তু অগ্রগতি প্রায় শূন্যের কোঠায়। তিনটি ভবনের জন্য বরাদ্দ ছিল হাজার কোটি টাকার বেশি, এখন সেই ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ-তিনগুণ। এই চিত্র রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা এবং জবাবদিহির ঘাটতির উদাহরণ হয়ে থাকবে।

প্রকল্পগুলো শুরু হয়েছিল ২০১৩ সাল থেকে। পদ্মা অয়েল কোম্পানির ভবন নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২১ কোটি টাকা, এখন তা প্রায় ১৯৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। মেঘনা অয়েল কোম্পানির ১৯ তলা ভবনের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬১৭ কোটি টাকা, যা এখন আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়ায়। যমুনা অয়েল কোম্পানির প্রকল্প ব্যয় ১৫৪ কোটি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২২ কোটিতে। অথচ এগুলোর কোনোটি এখনও শেষ হয়নি। ঠিকাদাররা মাঝপথে কাজ ফেলে চলে গেছে, নতুন ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল গ্রাহকের কাছে সাশ্রয়ী দামে, নিরাপদভাবে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা। অথচ সেই মূল কাজটি উপেক্ষা করে তারা মনোযোগ দিয়েছে বিলাসবহুল ভবন নির্মাণে। এটি স্পষ্ট করে যে, পরিকল্পনার চেয়ে প্রদর্শনই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বিলাসী প্রকল্পের অর্থ শেষ পর্যন্ত গ্রাহকের ঘাড়েই চাপে। কারণ কোম্পানিগুলো তাদের ব্যয়ের ভার জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করে জনগণের কাছ থেকেই আদায় করে। অর্থাৎ ব্যর্থ প্রকল্পের মূল্য দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।

এমন পরিস্থিতিতে তেল কোম্পানিগুলোর ভবিষ্যৎ প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠেছে। সরকার ইতোমধ্যেই বেসরকারি খাতকে তেল আমদানি ও বিপণনের সুযোগ দিয়েছে। এতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার ভূমিকা ভবিষ্যতে আরও সীমিত হয়ে পড়বে। ফলে যেসব ভবনকে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর অবশেষে অলস সম্পদে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকল্প গ্রহণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, ব্যয় বিশ্লেষণ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব বহুদিনের। ‘যত প্রকল্প, তত ব্যবসা’ সংস্কৃতি প্রশাসনের গভীরে গেঁথে গেছে। এতে প্রকৃত প্রয়োজন নয়, বরং কারা কীভাবে লাভবান হবে সেটিই মুখ্য হয়ে পড়েছে। এই সংস্কৃতি ভাঙা জরুরি। সরকারি টাকায় নেওয়া প্রতিটি প্রকল্পের জন্য স্বচ্ছ হিসাব, জনসমক্ষে অগ্রগতি প্রতিবেদন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা আবশ্যক।

সম্প্রতি জ্বালানি সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দ্রুত প্রকল্প শেষ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে- এটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে কাগজে-কলমে নির্দেশ নয়, মাঠপর্যায়ে কঠোর তদারকি ও দায় নির্ধারণ না করলে কোনো বাস্তব পরিবর্তন ঘটবে না।

অর্থনীতি এখন সংকটে, রাষ্ট্রের প্রতিটি টাকা মূল্যবান। এমন সময়ে অকার্যকর বিলাসী প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা আটকে থাকা অর্থনৈতিক অনিয়ম বলেই গণ্য করা উচিত। রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোকে বুঝতে হবে- জনগণের টাকায় বিলাসিতা নয়, জবাবদিহিই হওয়া উচিত তাদের প্রথম দায়িত্ব। এখনই সময় এই ব্যর্থ প্রকল্পগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার। অন্যথায়, পদ্মা-মেঘনা-যমুনার এই অর্ধনির্মিত ভবনগুলো রাষ্ট্রীয় অপচয়ের নিদর্শন হিসেবেই ইতিহাসে জায়গা করে নেবে।