কবে মিলবে নিরাপত্তা

শাকিলা খাতুন
০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
কবে মিলবে নিরাপত্তা

শিশু- মানবজীবনের সবচেয়ে পবিত্র ও সম্ভাবনাময় অধ্যায়। সমাজের প্রতিটি অগ্রগতির সূচনা হয় একেকটি শিশুর চোখে দেখা স্বপ্নের ভিত থেকে। কিন্তু বাস্তবতার নির্মম রূপ বহু শিশুর জীবন থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে সেই স্বপ্ন দেখার অধিকারটুকুও। দারিদ্র্য, বৈষম্য, অজ্ঞতা, সামাজিক অবহেলা এবং রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার ফলে আমাদের সমাজে অসংখ্য শিশু বেড়ে উঠছে এক গভীর ঝুঁকির পরিখায় বন্দি হয়ে। তারা বই-খাতার বদলে হাতে তুলছে হাতুড়ি, মালপত্র; নিরাপদ আশ্রয়ের বদলে রাত্রি কাটাচ্ছে খোলা আকাশের নিচে; স্নেহময় পরশের বদলে পাচ্ছে লাঞ্ছনা ও সহিংসতা।

বাংলাদেশে শিশুশ্রম একটি বহুল প্রচলিত ও জটিল সামাজিক সমস্যা। সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা অনুসারে, দেশে প্রায় ৩৫-৪০ লাখ শিশু বিভিন্ন প্রকার শ্রমে নিযুক্ত। তারা কাজ করে চায়ের দোকান, গাড়ির গ্যারেজ, কনস্ট্রাকশন সাইট, পোশাক কারখানা কিংবা গৃহকর্মে।

শিশুশ্রমের মূল কারণ হলো দারিদ্র?্য। দরিদ্র পরিবারে শিশুদের উপার্জন না থাকলে সংসার চলে না। শিক্ষার সুযোগ ও প্রাসঙ্গিক দক্ষতা উন্নয়নের অভাবও তাদের শ্রমের দিকে ঠেলে দেয়। মালিকরা শিশুদের ব্যবহার করেন, কারণ তারা কম মজুরিতে বেশি কাজ করে এবং প্রতিবাদের শক্তি রাখে না। এই শোষণ শিশুদের আত্মমর্যাদা ও মানসিক বিকাশকে চূর্ণ করে দেয়।

রাস্তায় থাকা শিশুদের জীবন আরও অনিশ্চয়তায় ভরা। পরিবার হারানো, দারিদ্র?্য, পারিবারিক সহিংসতা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা ঘর হারায়। তাদের নেই নিরাপদ বাসস্থান, পর্যাপ্ত খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা বা শিক্ষা।

রাস্তার শিশুরা প্রায়ই অপরাধচক্রের শিকার হয়। কিছু অবৈধ কাজ বা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হয়। তাদের জন্মনিবন্ধন ও পরিচয়পত্র না থাকার কারণে রাষ্ট্রীয় সেবা থেকেও বঞ্চিত হয়। ফলে তারা এক অদৃশ্য নাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠে, যারা নাগরিক অধিকার, সুরক্ষা ও ভালোবাসা কিছুই পায় না। বাংলাদেশে শিশু সুরক্ষার জন্য আইন ও নীতিমালা রয়েছে। তবে বাস্তবায়নে ঘাটতি- বাজেটের অভাব, প্রশাসনিক জটিলতা, জনবল সংকট এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও তথ্যের ঘাটতিও প্রতিবন্ধকতা।

সামাজিক মনোভাবও বাধা। অনেকেই শিশুশ্রম বা শাস্তিকে স্বাভাবিক মনে করেন। সমাজ যখন সহিংসতা গোপন রাখে বা অবহেলা করে, অপরাধীরা নির্ভয়ে কাজ চালিয়ে যায়। ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের রক্ষা করতে দারিদ্র?্য হ্রাস, শিক্ষা বিস্তার ও সামাজিক সচেতনতা জরুরি। পরিবারকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিলে শিশুদের শ্রমের প্রবণতা কমবে। শিক্ষাকে মানসম্মত ও আকর্ষণীয় করতে হবে। আইন বাস্তবায়নে প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। শিশু সুরক্ষা সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে। পুলিশ, সমাজসেবা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিভাগ এবং বেসরকারি সংস্থা যৌথভাবে শিশু সুরক্ষা নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করবে। রাস্তায় থাকা শিশুদের জন্য জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র, খাবার ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষ বিদ্যালয়, থেরাপি সেন্টার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা গড়ে তুলতে হবে।

শিশুরা সমাজের ভবিষ্যৎ। প্রতিটি শিশুর জীবন সমান মূল্যবান- ধনী বা দরিদ্র, সক্ষম বা প্রতিবন্ধী। ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের সুরক্ষা কেবল মানবিক দায়িত্ব নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও মৌলিক শর্ত। যে সমাজ তার শিশুদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, সেই সমাজ ভবিষ্যতের প্রতিকূলতার মুখে পড়বে। শিশুদের জীবন থেকে নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্নেহ কেড়ে নেওয়া মানে পুরো সমাজের সম্ভাবনা হারানো।

রাষ্ট্র ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে। আইন থাকা যথেষ্ট নয়; তা কার্যকর করতে প্রশাসনিক দক্ষতা, বাজেট বরাদ্দ, সমন্বিত কার্যক্রম এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় সমাজকে সচেতন হতে হবে। শিশুদের প্রতি সহানুভূতি, শ্রদ্ধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সমাজের নৈতিক দায়িত্ব।

শিশুরা শুধু স্নেহ বা করুণার দাবি রাখে না; তারা ন্যায্য অধিকার, নিরাপত্তা, শিক্ষা এবং সম্মান চায়। তাদের স্বপ্ন রক্ষা করলে আমরা ভবিষ্যতের একটি শক্তিশালী, জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ নিশ্চিত করতে পারব। শৈশব হারালে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ হারাই। তাই আজই পদক্ষেপ নিতে হবে- শিশুদের জীবন নিরাপদ করতে, তাদের স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করতে এবং সমাজকে এমন করে গড়ে তুলতে- যেখানে কোনো শিশু আর সহিংসতা, শোষণ বা অবহেলার শিকার হবে না।


মোছা. শাকিলা খাতুন : তেকানীচুকাইনগর, সোনাতলা, বগুড়া