শারদীয় দুর্গোৎসবে সম্প্রীতির বাংলাদেশের চিত্র
পূজার ছুটির পর প্রথম দিনে অফিসে এসেই টেবিলে নাড়ুর বাটি পেলাম। আমাদের এক সহকর্মী গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছেন। মুহূর্তেই মনে পড়ল ছোটবেলার কথা। আমি যেখানে বেড়ে উঠেছি, মাদারীপুরের খাসেরহাটে, সেখানে পূজার সময়ে হরেক রকমের নাড়ু খেতে পেতাম। ঈদের সময়ে সহপাঠীরা আমাদের বাড়িতে যেমন আসত, তেমনি পূজার সময়ে সুকান্ত ও পবিত্রদের বাড়িতেও যেতাম। ঈদ এবং পূজা দুটিই ছিল উৎসব। বহু বছর পর বাটিভর্তি হরেক রকম নাড়ু দেখে শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ল। এবার পূজা উৎসবের যে দিকটি উল্লেখযোগ্য সেটি হলো- নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপন করা হয়েছে। ধর্ম যার যার বাংলাদেশ সবার- এই মন্ত্রটিই যে আমাদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে সেটি আবারও দেখা গেল।
ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল। পুরাণ অনুসারে শ্বশুরবাড়ি কৈলাস (স্বর্গলোক) থেকে কন্যারূপে দেবী দুর্গা বাপের বাড়ি বেড়াতে মর্ত্যলোকে এসেছিলেন। এবার দেবী দুর্গা গজে (হাতি) করে এসেছেন। বিদায় নিয়েছেন দোলায় (পালকি) চড়ে।
পুরাণে আছে, অসুরশক্তির কাছে পরাভূত দেবতারা স্বর্গলোকচ্যুত হয়েছিলেন। এই অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে একত্র হন দেবতারা। অসুরশক্তির বিনাশে অনুভূত হলো এক মহাশক্তির আবির্ভাব। দেবতাদের তেজরশ্মি থেকে আবির্ভূত হলেন অসুরবিনাশী দেবী দুর্গা। শারদীয় দুর্গাপূজার পুণ্যলগ্ন শুভ মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবীপক্ষ শুরু হয়। দুর্গাষষ্ঠীর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্গাপূজা শুরু হয়। ধারাবাহিকভাবে মহা ষষ্ঠী, মহা সপ্তমী, মহা অষ্টমী, মহা নবমী ও বিজয়া দশমী।
বাংলাদেশে যে কোনো উৎসব উদযাপনের একটি রাজনীতি রয়েছে। হোক সেটা সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা সাংস্কৃতিক। উদযাপনের যে রাজনীতি এটাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারাদেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মণ্ডপ ও মন্দিরে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত বছর সারাদেশে ৩১ হাজার ৪৬১টি দুর্গাপূজা হয়েছিল। সেই হিসাবে এবার ১ হাজার ৮৯৪টি দুর্গাপূজা বেশি হয়েছে।
এ ছাড়া এবার ঢাকা মহানগরে ২৫৯টি পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে; যা গত বছরের তুলনায় ৭টি পূজা বেশি। মহা ধুমধামে অঞ্জলি, আরতি, পূজা-অর্চনায় শারদীয় দুর্গোৎসবের বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী উৎসবের সমাপ্তি হয়েছে। বিসর্জনের পরে স্বেচ্ছা রক্তদান কর্মসূচি ছিল এবার। খবর নিয়ে জানলাম প্রতিবছর বিজয়ার দিনে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে স্বেচ্ছা রক্তদানের আয়োজন করা হয়। এই যে উৎসবের মাঝেও ত্যাগের কর্মসূচি এটি আরেকবার মনে করিয়ে দিল, সকল ধর্মের সারকথা হচ্ছে- ত্যাগই ধর্ম।
আবহমানকাল ধরে এদেশে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে। জাতি হিসেবে আমাদের সকল অর্জন ও প্রাপ্তিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে প্রতিটি গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামে এখানকার মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করেছে। পাহাড় থেকে সমতল- প্রতিটি নাগরিক গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামে সমান অংশগ্রহণ করছে। ধর্মীয় উৎসবের আড়ালে এখানে যে সম্প্রীতির অবস্থান- সেটি কখনও বিভক্ত হয়নি। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে- বিগত কয়েক বছর দুর্গাপূজার সময়ে দেশের শান্তি বিনষ্ট করার জন্য একটি চক্র সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এবার এই দুষ্টচক্র তেমন সফল হতে পারেনি। দুর্গাপূজার যে ধর্মীয় দিক এসবের বাইরে এটি যে সামাজিকতার ও লোকাচারের বার্তা দিয়ে যায় এটিও চিরায়ত।
শারদীয় দুর্গাপূজার মহা নবমীতে ঢাকঢোলের বাদ্যতে মুখর হয়ে উঠেছিল রাজধানীর পূজামণ্ডপগুলো। টেলিভিশনের সংবাদে পূজার যে চিত্র দেখা গেল তাতে উৎসবমুখর বাংলাদেশের চিত্রই ফুটে উঠেছে। নবমীতে দেবী দুর্গা তীব্র লড়াইয়ের মাধ্যমে অসুর বিনাশ করেন। মহিষাসুর বধের এই বিজয় দিবসটি তাই দেবীভক্তদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেবী এই দিনে ভক্তদের মনোবাসনা পূরণ করেন।
আবার বিজয়া দশমীতে দর্পণ বিসর্জনের পরে সিঁদুরখেলার আয়োজন করা হয়েছে। সাধারণত এ আয়োজনে বিবাহিত নারীরা দেবীর চরণে সিঁদুর দান করে তা কৌটায় ধারণ করেন সারা বছর ব্যবহারের জন্য। এ সময় তাঁরা একে অন্যের কপাল ও চিবুকে দেবীর চরণ স্পর্শ করা সিঁদুর লাগিয়ে দেন।
এবার পূজা শুরুর আগে অর্থাৎ দুর্গাপূজার প্রস্তুতির সময় ১৩ জেলায় দুর্গা প্রতিমা ও মন্দিরে হামলার খবর পাওয়া গেছে। জেলাগুলো হলো- কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নেত্রকোনা, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, জামালপুর, নাটোর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত এসব ঘটনায় পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব হামলার ঘটনার জড়িত দুর্বৃত্তদের অনেকেই ধরা পড়েছে।
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতা আরও দৃঢ় ও অটুট হবে এটাই প্রত্যাশা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে একটি বৈষম্যহীন, ন্যায়ানুগ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের যে অভিযাত্রা, সেটি এগিয়ে নিতে হবে। সবার জন্য বাংলাদেশ নির্মাণের যে প্রতিশ্রুতি সেটি অটুট ও অর্জন করতে হবে।
এহ্্সান মাহমুদ : নির্বাহী সম্পাদক, আমাদের সময়; কথাসাহিত্যিক
মতামত লেখকের নিজস্ব
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?