সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা অপরিহার্য
সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান হিংস্রতা পুঁজিবাদের শিষ্টাচারী-অনুচর উদারনীতির অপারগতাকে বড় নির্মমভাবে উন্মোচিত করে দিয়েছে। অনেক আগে হিটলার-পরবর্তীকালে, ঔপন্যাসিক ইএম ফস্টার তার উদারনৈতিক অবস্থান থেকে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লিখেছেন। ওই অবস্থানের দুর্বলতাটা তার কাছে স্পষ্ট ছিল, যে জন্য তিনি ১৯৫১ সালে প্রকাশিত তার প্রবন্ধের বইয়ের নাম দিয়েছিলেন ঞড়ি ঈযববৎং ভড়ৎ উবসড়পৎধপু। নিয়ম হলো দুটি নয়, তিনটি ধ্বনি- থ্রি চিয়ার্স- দেওয়া; কিন্তু তিনি তিনটি ধ্বনি দিতে পারছেন না, দুটিই দিচ্ছেন; কেননা তিনি দেখতে পাচ্ছেন যে, তিনটি দিতে হলে ভেতরে যে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস দরকার সেটি তার নেই। ফস্টার বলতে পছন্দ করতেন যে, তিনি সাহসী নন, সাহসী হলে কোনো একটি মতবাদকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরতেন এবং সে মতবাদ হয়তো কমিউনিজমই। ফস্টার বুঝে নিয়েছিলেন, যেমন বুঝেছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেলও; যে এ যুগে মতবাদ দুটিই, একটি ফ্যাসিবাদ অন্যটি কমিউনিজম। ফস্টারের পক্ষে দুটির কোনোটিই গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না, যে জন্য তিনি উদারনীতিকই রয়ে গেলেন। কিন্তু তার কালে উদারনীতি যে অফলপ্রসূ হয়ে পড়েছে এর প্রমাণ তার নিজের সাহিত্যিকজীবনের ভেতরই রয়েছে। তার প্রধান উপন্যাসের নাম অ চধংংধমব ঃড় ওহফরধ, যেটি তিনি লিখেছেন ১৯২৪-এ; এর পরও তিনি ৩৬ বছর জীবিত ছিলেন; এই সময়ে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, কিন্তু উপন্যাস লেখা আর হয়নি। তার কারণ বোধ করি এই যে, পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যের ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা, পারস্পরিক দূরত্ব, ব্যক্তির গৃহহীনতা ইত্যাদির বৃদ্ধিতে যে নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাকে ধারণ করার মতো ক্ষমতা তার উদারনীতির ছিল না; পারতেন যদি উদারনীতি ত্যাগ করে ইয়েটস, কনরাড, লরেন্স, জয়েস, এলিয়টের মতো গণতন্ত্রবিরোধী ও পশ্চাৎমুখী হতেন, কিন্তু সেটা হওয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, যেমন সম্ভব ছিল না সমাজতন্ত্রী হওয়া। না ঘরের না ঘাটের অবস্থায় তার সৃষ্টিশীলতাই স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে।
এই বিপদটা নজরুলের ক্ষেত্রে কিন্তু ঘটেনি। তার কারণ তিনি উদারনীতিকদের একাংশের মতো যেমন পিছু হটেননি, তেমনি আবার বিভ্রান্ত হয়ে একই অবস্থানে দাঁড়িয়েও থাকেননি, তিনি এগিয়ে গেছেন সামনে; তার অঙ্গীকারটা ছিল নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের। কিন্তু নজরুলও তো শেষ পর্যন্ত স্তব্ধই হয়ে গেলেন। এটা ঘটল পুঁজিবাদের নৃশংস আক্রমণেই; অর্থনৈতিক সংকট, পারিবারিক শোক, সর্বোপরি সহযাত্রীর অভাবে নজরুলকেও থেমে যেতে হয়েছে; অনেকটা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়ার মতো ব্যাপারটা ঘটে গেছে তার ক্ষেত্রে।
উদারনীতির জন্য দুটি ভয় কার্যকর। পুঁজিবাদের সে অনুসারী ঠিকই, কিন্তু আবার সমালোচকও বটে। পুঁজিবাদ যে মানুষকে বিচ্ছিন্ন ও উৎপাটিত করে, সে যে সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করতে চায়, উদারনীতিকরা এ বিষয়ে সচেতন, যে জন্য পুঁজিবাদের সঙ্গে তাদের একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। কিন্তু তাদের আরও বড় ভয় হচ্ছে সমাজ বিপ্লবকে, যে জন্য তারা জনগণকে সচেতন করতে চায় না, পারলে দূরে সরিয়ে রাখে। কিন্তু পুঁজিবাদ তো আর পুঁজিবাদের বিকল্প হতে পারে না, যে জন্য আমরা দেখি যে সাম্রাজ্যবাদপীড়িত দেশগুলোতে অভিমান-অহংকার, আহত আত্মসম্মানবোধ এবং আত্মপরিচয়ের অন্বেষণে উদারনীতিকরা পিছু হটে, হটে গিয়ে এমনকি মৌলবাদের কাছেও চলে যায়। বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে ওঠেন ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী, অরবিন্দ চলে যান আশ্রমে, বিপিন পাল পরিণত হন বৈষ্ণবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমান বলে ফেলেন যে তিনি একজন মুসলমান।
তথাকথিত ইসলামি মৌলবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্বটা এখন বেশ আড়ম্বরপূর্ণ। কিন্তু দুইয়ের ভেতর বৈরিতাটা অনেকটা দুই মল্লযোদ্ধার মতো, যাদের একজন অসম্পূর্ণ অন্যজনকে ছাড়া। জর্জ বুশের জন্য ওসামা বিন লাদেন খুবই জরুরি ছিল, নইলে তিনি কুস্তি করবেন কার সঙ্গে, কীভাবে প্রমাণ দেবেন যে, তিনি কত বড় বীর? বিন লাদেন তাকে অজুহাত সরবরাহ করবেন সন্ত্রাসবিরোধিতার নাম করে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর এবং আমেরিকাবাসীকে ভয় দেখিয়ে তাদের ভোট কেড়ে নেওয়ার। একইভাবে বিন লাদেনের জন্য বুশ ছিল অপরিহার্য, নইলে তিনি কার বিরুদ্ধে ডাক দেবেন জেহাদের এবং আত্মপ্রকাশ করবেন মস্তবড় বীর ও নেতা হিসেবে? কিন্তু উভয়েই ছিলেন পুঁজিবাদের রক্ষক; উভয়েই ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতায় বিশ্বাস করতেন এবং সমাজতন্ত্রীদের শয়তানের চেলা হিসেবে দেখেন। এই যে ক্রুসেডার ও জেহাদি- এরা কেউই গণতন্ত্রে আস্থা রাখে না, উভয়েই ফ্যাসিবাদী।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
রাজনীতির ক্ষেত্রে উদারনৈতিকরা যখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে তখন তার কারণ ক্ষমতা ভাগাভাগির লড়াই ভিন্ন অন্য কিছু নয়। যে জন্য আমেরিকায় রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের ব্যবধান ভোটযুদ্ধ ভিন্ন অন্য কিছুতে চোখে পড়ে না; এবং ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ব্যাপারে ব্রিটিশ লেবার পার্টির অবস্থান কনজারভেটিভ পার্টির থেকে মোটেই ভিন্ন ছিল না।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতাকে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা উপমহাদেশে হয়েছে বৈকি। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু, এরা সবাই করেছেন। কিন্তু একমাত্র গান্ধী ছাড়া অন্য কারও পক্ষেই শ্রেণি-দূরত্ব অতিক্রম করে জনগণের বোধগম্য ভাষায় কথা বলা সম্ভব হয়নি। গান্ধী সেটা পেরেছিলেন; কিন্তু তিনি তো লেনিন নন, তার আগ্রহ সমাজবিপ্লবে ছিল না, তিনি পেছনে হটে চলে গিয়েছিলেন রাম-রাজত্বের দিকে। নেহেরু যেহেতু জনগণের কাছে সরাসরি যেতে পারতেন না, তাই নির্ভর করতেন গান্ধীর ওপর। কিন্তু নেহেরু সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতায় তেমন অনমনীয় ছিলেন না, সুভাষ বসু যেমন ছিলেন; সুভাষ বসুও গান্ধীর সমর্থন চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আপসবিমুখতার কারণে সেটা পাননি। ব্যর্থ হয়ে তিনি ফরোয়ার্ড ব্লক নামে নতুন দল গঠন করেছিলেন, কিন্তু সেই দলের পক্ষেও সম্ভব ছিল না ব্যাপক জনসমর্থন সংগ্রহ করা। বাধ্য হয়ে তিনি দেশের বাইরে চলে গেলেন, সেখান থেকে বেতারে জনগণকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য ডাক দিয়েছেন, পরে সশস্ত্র সেনাবাহিনীও গড়ে তুলেছেন, কিন্তু সেটাও তাকে গড়তে হয়েছিল প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়েই, দেশের জনগণকে যে সংগঠিত করবেন তা তার পক্ষেও সম্ভব ছিল না।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের পূর্বতন অভিজ্ঞতা বলছে যে, সর্বপ্রথম যেটা প্রয়োজন সেটা হলো সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ সম্পর্কে মোহমুক্তি। এটা না থাকলে এক পা-ও এগোনো যাবে না, বরং পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই থাকবে বেশি। দ্বিতীয় কথা, জনগণকে সঙ্গে নিতে হবে। ভদ্রলোকদের ওপর ভরসা করে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা হয় বাগাড়ম্বরে পরিণত হবে, নয়তো হবে টিনের তলোয়ার নিয়ে লড়াই, কিংবা চলে যাবে সে মৌলবাদী পশ্চাদপসরণের পথে। প্রতিষেধক হিসেবে যা অপরিহার্য সেটা হলো একটি স্থির লক্ষ্য, যেমনটা লেনিনের ছিল। এ ক্ষেত্রে অহমিকা-অহংকার, আত্মপরিচয় নিয়ে গর্ব এগুলো প্রতিবন্ধক বটে। সুভাষ বসু সব দিক দিয়েই গণতান্ত্রিক ছিলেন, কিন্তু তিনি যখন ‘ভারতীয়’ সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, বিবেকানন্দের ‘দরিদ্রনারায়ণ’কে নিয়ে আসেন সামনে, তখন বুঝতে হয় তার পক্ষে লেনিন হওয়া কত কঠিন। বাংলাদেশে শেখ মুজিব জনপ্রিয়তার যে শীর্ষে পৌঁছেছিলেন, তেমনটা অন্য কোনো নেতা অতীতে পৌঁছতে পারেননি এবং শেষ পর্যন্ত তাকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই লড়তে হয়েছে, কিন্তু তিনিও সমাজবিপ্লবী হতে পারেননি, জাতীয়তাবাদীই রয়ে গেছেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন জনগণের নেতা, তিনি আস্থাবান হয়ে উঠেছিলেন সমাজতন্ত্রে, কিন্তু সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তিনি আবার ধর্মকেও যুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে উদারনৈতিক নয়, প্রকৃত গণতান্ত্রিক (নামান্তরে সমাজতান্ত্রিক) অবস্থান থেকেই। লক্ষ্য থাকবে দেশের ভেতরে সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার যে শাসক শ্রেণি তাদের পরাভূত করে রাষ্ট্রে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, রাষ্ট্রক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটানো এবং সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই সংগ্রাম যেমন হবে স্থানীয় তেমনি তাকে হতে হবে আন্তর্জাতিক। সারাবিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদবিরোধী যে আন্দোলন চলছে এ হবে তারই অংশ।
কাজী নজরুল ইসলামের প্রসঙ্গটা প্রাসঙ্গিকভাবেই আসে। তিনি যেভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন, যা ছিল একাধারে সাহসী, জনসম্পৃক্ত, মেরুদণ্ডসম্পন্ন, দৃষ্টিভঙ্গিতে আন্তর্জাতিক এবং নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ, সেখানে বোধকরি ছোট হলেও উজ্জ্বল একটি দৃষ্টান্ত আছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতাটা কেমন হওয়া উচিত এবং কোন পথে তার এগোনো দরকার।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
মতামত লেখকের নিজস্ব