চলে গেলেন প্রিয় রফিক ভাই

মযহারুল ইসলাম বাবলা
০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:৩৬
শেয়ার :
চলে গেলেন প্রিয় রফিক ভাই

পরিণত বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, কিন্তু তার এই চলে যাওয়াটা আমাদের পক্ষে বেদনাদায়ক বটে। তার কথা ভোলার নয়। তিনি আমাদের জন্য যে শিক্ষা রেখে গেলেন, সেটা অসামান্য বটে। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আমাদের মাঝে অটুট থাকবে।

আমাদের জ্ঞানী-পণ্ডিতের সংখ্যা নিতান্ত স্বল্প না হলেও সমাজে জ্ঞানী, বিবেকবান, নীতিনিষ্ঠ পণ্ডিতজনের বড়ই অভাব। যারা মেরুদণ্ড সোজা রেখে আজীবন চলেছেন, তেমন মানুষের তো আকাল চলছে দেশে। হাতেগোনা যে দু-চারজন আছেন এবং ছিলেন, তাদেরই একজন আহমদ রফিক। যিনি আমাদের ক্ষমতার রাজনীতির কেনাবেচার হাটে পার্থিব লোভ-লালসায় নিজেকে কখনও বিকিয়ে দেননি। বিপরীতে আমাদের শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক-স্বেচ্ছাচারী এবং ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বরাবর সোচ্চার থেকেছেন। প্রতিবাদে জনগণের কাতারে এসে শামিল হয়েছেন। আহমদ রফিক যিনি কারও রফিক স্যার, কারও রফিক ভাই। যাকে আমরা জাতীয় নানা দুঃসময়ে কাছে পেয়েছি। যিনি মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অটল থাকতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। সময়জ্ঞানের ব্যত্যয়ে যিনি কাউকে ছেড়ে কথা বলেননি। রফিক ভাই ঘড়ির কাঁটা ধরে যেমন নিজে চলতেন, অন্যকেও তেমনি সময়জ্ঞানে সচেতন হতে বাধ্য করতেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বড়ই কঠোর।

সময়টা দেশভাগের অন্তিম সময়ের। দেশভাগ এবং বাংলাভাগ প্রায় চূড়ান্ত। বাংলাভাগে উত্তাল পূর্ব বাংলার সব অঞ্চল-জনপদ। গ্রামের যুবকরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে মিছিল, সভা-সমাবেশ করে মুসলমানের পৃথক রাষ্ট্রের যৌক্তিকতা তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে। স্লোগানে স্লোগানে মুখর ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আনন্দ-উল্লাস ধ্বনি চারদিকে। তখন যুবক আহমদ রফিককে দেশভাগ-পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। জনস্রোতের সেই ভাবনার বিপরীত ভাবনাই তাকে আতঙ্কিত করেছিল। সেই ভাবনার কেন্দ্রে ছিল মর্মান্তিক বাংলাভাগের অশুভ পরিণতির উপলব্ধি। দেশভাগে উচ্ছেদ, বিচ্ছেদ এবং উৎপাটনের শঙ্কায় তিনি উদ্বিগ্ন। পরিণতি আঁচ করতে পেয়ে শঙ্কিত। তিনি দেশভাগের উন্মাদনার কালেই দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি। ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো তার সেই চেতনা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, বাস্তবে সেটা ক্রমেই প্রকাশ পেয়েছে। পরিণত বয়সে তিনি নানামাত্রার গবেষণার ফাঁকে লিখেছেন, অসামান্য গ্রন্থ ‘দেশ বিভাগ : ফিরে দেখা।’ বইটি প্রথম আলোর বর্ষসেরা গ্রন্থ হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিল। তার চিন্তার অগ্রসরতা নানাভাবে নানা ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে। সনাতনী ধ্যান-ধারণার বিপরীতে জনমুক্তির ভাবনা একইভাবে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের মৌলিক আকাক্সক্ষাটি হচ্ছে শ্রেণি উত্তরণ অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দীক্ষা। রফিক ভাই ছাত্র হিসেবে ছিলেন খুবই মেধাবান। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সংগত কারণে পরিবারের আকাক্সক্ষায় ও ইচ্ছায় তাকে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হতে হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র আহমদ রফিক জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। ভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরূপে তিনি মেডিক্যাল কলেজের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত-নেতৃত্বে ছিলেন এবং প্রত্যক্ষে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ যুক্ততার কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি পরবর্তীকালে ভাষা মতিনকে বন্দি করা হয় এবং মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র আহমদ রফিকের ওপর হুলিয়া জারি হলে বাধ্য হয়ে তাকে আত্মগোপনে যেতে হয়। প্রায় দুই বছর ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশি নজর এড়িয়ে গোপনে বসবাস করেন। সেই সময়ে চরম আর্থিক অনটনে খেয়ে-না খেয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও ছাত্রত্ব ফিরে পাওয়ার বিষয়টির সমাধান হয়নি। ওদিকে পরিবারের মেধাবী ছেলেটি আর ডাক্তার হতে পারল না, এমন শঙ্কায় পরিবারের মধ্যেও তীব্র হতাশা নেমে আসে। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে হুলিয়া প্রত্যাহারের পর আবার তিনি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রত্ব ফিরে পান এবং ইচ্ছাশক্তির কঠিন দৃঢ়তায় এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। লক্ষ্য বাস্তবায়নে তার একরোখা একাগ্রতাই এতে প্রমাণ করেছে। যেটি তিনি জীবনভর বহন করে এসেছেন। ডাক্তার হয়েও ডাক্তারি পেশায় তিনি যুক্ত হননি। করেননি সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের চাকরি এবং প্রাইভেট প্র্যাক্টিসও। ওষুধশিল্পের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পরে কজন মিলে ওষুধশিল্পও গড়ে তোলেন। কিন্তু সেখানেও অংশীদারদের সঙ্গে নীতিগত বিরোধে শূন্য হাতে সেখান থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। আর্থিক ক্ষতির মুখেও অংশীদারদের নীতিভ্রষ্টতাকে মেনে নিতে পারেননি, বেরিয়ে এসেছেন।

সম্পূর্ণ ভিন্নতর পেশায় থেকেও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি, গবেষণা এবং রাজনৈতিক মতাদর্শিতা থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন থাকেননি। ‘নাগরিক’ নামের মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং নানামুখী গবেষণামূলক রচনা লিখেছেন। লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার গবেষণা গ্রন্থগুলো কেবল দেশে নয়, ভারতেও সমান জনপ্রিয়। ভারত থেকে সম্মাননাসহ ট্যাগোর রিসার্স ইনস্টিটিউট তাকে রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য উপাধি দিয়েছে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে রবীন্দ্রজীবনী একটি খণ্ড তিনি লিখেছেন। সেটি প্রকাশিত হয়েছে এবং বাংলা একাডেমির ক্রমাগত অনুরোধেও শারীরিক অসুস্থতার জন্য লেখা সম্ভব হয়নি। লেখক-গবেষক হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় একুশে পদকসহ অসংখ্য পদক-সম্মাননা তিনি পেয়েছেন।

কিশোর বয়সেই তার চিন্তা-মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল চেতনা গড়ে উঠেছিল। সমাজের ধনবৈষম্য, শ্রেণিবিভক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনাচার এসব দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন বটে, তবে হতাশাগ্রস্ত হননি। বরং বিদ্যমান অনাচারী-ব্যবস্থা থেকে মুক্তির উপায়টি তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পেরে ক্রমেই মার্কসবাদী হয়ে ওঠেন। যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। পার্টির সদস্য পদও লাভ করেন। কিন্তু অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ওপর ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদী সোভিয়েত ইউনিয়নের মাত্রাতিরিক্ত খবরদারি-হস্তক্ষেপ তিনি মেনে নিতে পারেননি। আমাদের প্রেক্ষাপটকে এড়িয়ে আন্দোলনে-সংগ্রামে সোভিয়েত নির্দেশ পালনে কমিউনিস্ট পার্টির স্বাতন্ত্র্য ক্রমাগত ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কায় তিনি পার্টি ত্যাগে বাধ্য হন। তবে পার্টি ত্যাগ করলেও বিলোপবাদী হননি। আজীবন মার্কসীয় মতাদর্শকে বহন করেছেন। যার প্রকাশ ঘটেছে তার জীবনাচারে, লেখালেখি, গবেষণায় এবং নানাবিধ কর্মকাণ্ডে।

কর্মজীবনের ব্যস্ততা-সীমাবদ্ধতা এমনকি পারিবারিক সীমা পর্যন্ত অতিক্রম করে তিনি মার্কসবাদী চেতনায় অবিচল থাকার দৃষ্টান্ত রেখে এসেছেন। নিয়মিত গবেষণা ও জ্ঞানচর্চায় নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন। তার জ্ঞান বিতরণের মাধ্যম হচ্ছে লেখালেখি, যেটি মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত অবিরাম করেছেন। সময়কে অপচয় না করে প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে নিজে যেমন আলোকিত হয়েছেন, তেমনি সে আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন সমাজে। এমন অসামান্য মানুষ আমাদের সমাজে সত্যিই বিরল। নিজ কর্মগুণেই তিনি সবার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার প্রিয় রফিক স্যার-রফিক ভাই। বয়স তাকে দমাতে পারেনি। তার মধ্যে তারুণ্যের দীপ্তি সর্বক্ষণ বিরাজ করেছে। তরুণদের প্রতি তার যেমন ভালোবাসা, তেমনি আকর্ষণও। তরুণদের প্রতিই সর্বাধিক আস্থা-ভরসা রাখতেন। তরুণরাই সমষ্টিগত মুক্তির অধরাকে ধরায় পরিণত করতে পারবে বলে তিনি মনে করতেন। তরুণদের সঙ্গে তার নৈকট্য সর্বাধিক। তরুণরাই বদলাতে পারে বিদ্যমান ব্যবস্থা, তাই তরুণদের গভীর আস্থায় রাখতেন। সময় সচেতনতায় অসামান্য দৃষ্টান্ত রফিক ভাই। ঘড়ির কাঁটা ধরে চলতেন। সময়জ্ঞানের শিক্ষাটা তরুণদের দিতে ভোলেননি। ব্যতিক্রম হলে কাউকে ছাড়ও তিনি দিতেন না। রফিক ভাইয়ের সঙ্গে সময় নিয়ে আমরা বরাবরই শঙ্কায় থাকতাম। সময়ের হেরফেরে স্নেহপূর্ণ তিরস্কার শুনতে হতো। ব্যক্তিগত জীবনে সময়জ্ঞান নিয়মানুবর্তিতা, নীতিনিষ্ঠ না হলে কোনো ব্যক্তিই প্রকৃত মানুষরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। ব্যক্তিজীবনে মার্কসবাদী চর্চায় নিজেকে যুক্ত রাখতে না পারলে প্রকৃত মার্কসবাদীও হওয়া যায় না। রফিক ভাই কোনো মার্কসবাদী দলভুক্ত না হয়েও আজীবন মার্কসবাদী চর্চার মধ্যেই জীবন কাটিয়ে এসেছেন।

রফিক ভাই অত্যন্ত সহজ-সরল একজন মানুষ ছিলেন। যেমন মানবিক তেমনই স্নেহপ্রবণ। তার অতিসাধারণ জীবনযাপন আমাদের জন্য অনুকরণীয় বলেই মান্য করি। পার্থিব লোভ-লালসা, অর্থবিত্তের মোহ তাকে কখনও পথভ্রষ্ট-আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। সারাটি জীবন নির্লোভ-নির্মোহ জীবন কাটিয়েছেন। প্রায় আড়াই যুগ আগে স্ত্রী মারা গেছেন। নিঃসন্তান রফিক ভাইকে আগলে রেখেছেন দুজন নারী-পুরুষ। তারাই তাকে দেখভাল করেন। স্ত্রীর জীবদ্দশা থেকেই তারা দুজন তাদের পরিবারে যুক্ত হয়ে আছেন। ওই দুজনকে নিয়েই রফিক ভাই নিউ ইস্কাটনের ভাড়া বাসায় একটি সমতার পরিবারে বসবাস করছেন। ডাক্তার বলে নয়, সুদূর কৈশোর থেকেই অত্যন্ত নিয়মানুবর্তিতায় জীবনযাপন করেছেন। খাদ্যাভ্যাস থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে খুবই পরিমিত ছিল তার জীবনাচার। পরিণত বয়সেও তারুণ্যে ভাটা পড়েনি। বার্ধক্যজনিত রোগ-ভোগ পোহাতে হয়েছে। কিন্তু এতে তার কর্মস্পৃহা কখনও থেমে থাকেনি। নিয়মিত লিখেছেন, করেছেন গবেষণা। পড়াশোনাও নিয়মিত করতেন। জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে প্রতিবাদীদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদেও শামিল হয়েছেন। রফিক ভাই রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নিজের উপার্জিত সব অর্থের বিনিময়ে গড়ে তুলেছিলেন অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান।

আমাদের সবার অত্যন্ত ভালোবাসার প্রিয় ব্যক্তিত্ব রফিক ভাইকে বিদায় জানাই গভীর শ্রদ্ধায়।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত